Advt

Advt

Saradiya Sur (Probondho / Feature) by Shaktipada Mukhopadhyay, Tatkhanik Bangla / Bengali e magazine Online Reading Free

 

Saradiya Sur (Probondho / Feature) by Shaktipada Mukhopadhaya, Tatkhanik Bangla / Bengali e magazine Online Reading Free

শারদীয়া সুর

শক্তি পদ মুখোপাধ্যায়

“বাজলো তোমার আলোর বেনু”,আনমনা হয়ে সুরের সাগরে ডুবেছিলাম।হঠাৎ পাশ থেকে অফিসের একজন যেন চুল ধরে ভাবের সাগর থেকে টেনে তুললো।“কি হোল স্যার? কি ভাবছেন?” “না, না, কিছুনা”,বলে কাজে মন দিলাম।কিন্তু মনে ঐ সুরটা বেজেই যাচ্ছিল। তখন গুয়াহাটিতে আছি। মহালয়ার দিনেও ছুটি নেই। খালি ভাবছি, কোলকাতায় তখন সবার মন মহালয়ার তর্পণের শুদ্ধিতে নির্মল হয়ে গেছে।আর আমি পরবাসে।

গুয়াহাটিতে বেশ কয়েকটা পূজো হয়। সকালে ব্রহ্মপুত্রের পার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখেছি, নৌকা করে কিছু প্রতিমার মণ্ডপযাত্রা।দূর থেকে মাথায় হাত ঠেকিয়ে, চোখের জল মুছতে ভুলে গিয়েছিলাম।আমাদের মেসে একজন শুধু শিলং নিবাসী ভদ্রলোক ছিলেন। আমি বাদে বাকি সবার বাড়ি শিলচরে। মেসের পরানদা একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিতা, যাইবেন নি বাড়ি?” এইকথা শুনে আমি মন খারাপ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে ব্রহ্মপুত্রের পারে পার্কে গিয়ে বসে রইলাম। তখন সন্ধ্যা। আকাশের অন্ধকার যেন আমার মনকে গ্রাস করেছে। পূজোর কদিন দুএকটা মণ্ডপে ঘুরলাম। মনে হচ্ছিল দুর্গাঠাকুরের মুখটা বড়ই করুণ। বিজয়াদশমীর দিন মেসের চন্দবাবুকে লাড্ডুর মধ্যে ভাঙ খাইয়ে ওঁনার সাক্ষাৎকার নেওয়া হোল, আর  টেপরেকর্ডারে ওঁনার জীবনের অনেক গোপন কথা আর গোপন রইলো না। পরদিন চন্দবাবুকে ওঁনার দেওয়া সাক্ষাৎকার শোনালে,উনি রাগে গজ্‌গজ্‌ করতে করতে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, আর কোনদিন আমাদের দেওয়া মিষ্টি গ্রহণ করবেন না। যদিও পরে আর একদিন, ওঁনাকে পায়েসের সাথে ভাঙ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল।

এরপর যখন রাউরকেলা পোস্টিং হোল, সেখানেও পূজোতে ছুটি দূরস্থ। আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলা যেন আরও কান্নাভেজা মনে হোল টেপরেকর্ডারে। কয়েকটি ছোট পূজো দেখেই মনকে স্বান্তনা দিতে হয়েছে। কিন্তু অষ্টমীর অঞ্জলি বা বিজয়াদশমীর আনন্দ,সবই ভুলতে হোল। এ যেন,

 

     পূজা শুধু আসে যায়

     আমায় কভু খুঁজে না পায়।

 

যখন বম্বে ট্রান্সফার হলাম, মহালয়ার সুর যেন কিছুটা হলেও মন ছুঁয়ে গেল।

 

    “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর।

     ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা।”

 

সকালে টেপরেকর্ডারে শোনা মহালয়ার সুর মনে মনে গুনগুন করছিলাম। কিন্তু পেছন থেকে ধাক্কা,“আরে ক্যা হুঁয়া। ছল্‌ পুড়ে, ছল্‌ পুড়ে। আগে বাড়ো, আগে বাড়ো”। তাড়াতাড়ি অফিসের পথে পা বাড়ালাম।বম্বেতে প্রধান দুর্গাপূজা দাদারের বেঙ্গলী অ্যাসোসিএশনের পূজা। পূজা প্রাঙ্গণে প্রতিমার স্থান, বিভিন্ন স্টলের স্থান,সমস্ত কিছু সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট ছিল। মাইকে বাংলাভাষায় বিভিন্ন ঘোষণা শুনে বেশ গর্ববোধ হচ্ছিল। প্রবাসের পূজোতেও মনে হোল,

 

     “শান্তি দিলে ভরি দুঃখরজনী গেল তিমির হরি।

      প্রেমমধুর গীতি বাজুক হৃদে নিতি নিতি মা।

      প্রাণে সুধা ঢালে। মরি গো মরি”। 

 

কিন্তু পরের বছর পূজোর আকাশ নিরানন্দে পরিণত হোল। যেহেতু দশেরা ছাড়া পূজোতে কোন ছুটি ছিল না, দশমীর দিন অফিসের পর ঠাকুর দেখতে আমাদের আন্ধেরীর অফিস-আবাসনের কাছাকাছি রামকৃষ্ণ মিশনের পূজো দেখতে যাই। কিন্তু আমরা পৌঁছানোর আগেই প্রতিমা নিরঞ্জন সমাপ্ত হয়ে যায়। আমার যেন মনে হোল, “অভাগা যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়”। প্রতিমার মুখদর্শনে অপারগ, আমি যেন ভাগ্যের অশনি সংকেতের অনুভব করলাম।

তবে পোর্টব্লেয়ারে যখন বদলি হলাম, পরবাসের পূজোর মজা স্বদেশের থেকে কম মনে হয় নি। নিজেকে প্রবাসী না ভেবে, পুরবাসীই মনে হোত। ওখানকার বেঙ্গলী অ্যাসোসিএশনের পূজো সত্যিই হৃদয়স্পর্শী। মহালয়ার আগে থেকেই একটা সাজসাজ রব। প্রতিমার রূপটানে, অলংকরনে, অস্ত্রসজ্জায়, দ্রুত উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকলো। এরই মধ্যে অফিসের পর, সঙ্গীত, আবৃতি ও নাটকের মহড়া চলতে থাকে। মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত শারদীয়া আগমনীর মহড়াও পূজোর আনন্দকে যেন আরও ত্বরান্বিত করলো। মহালয়ার দিন রেডিওতে আকাশবাণী পোর্টব্লেয়ার কেন্দ্র থেকে, মহিলাদের আগমনীর গান শুরু হোল। “ইয়া চণ্ডী, মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনী”, শুনতে শুনতে গায়ের রোঁয়া যেন খাঁড়া হয়ে উঠলো। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আর যেন তর সইছিল না। পূজো মণ্ডপের পাশে পরপর বিভিন্ন স্টল খোলা হয়েছিল। তার একটিতে ছিল আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রদর্শন। পোর্টব্লেয়ারের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই বাঙ্গালী। কিন্ত কালাপানির কোন অগৌরব এখানে নেই।পূজোর সকাল থেকেই অত্যন্ত ব্যস্ততা। রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপূজার সাথেও জড়িত হওয়ার সৌভাগ্যে, এক শুদ্ধ, অনাবিল শারদীয়ার অভিজ্ঞতা হয়।প্রতিমার কাঠামো গঠন থেকে শুরু করে মধ্যাহ্নের প্রসাদ বিতরণ, সবই আশ্রমের আবাসিকেরা অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। আশ্রমের সামনের সমুদ্রের কলতান ও উচ্ছ্বাস, মন্দিরের পূজোর ভাবগম্ভীর পরিবেশের সাথে যেন আপন মনে মিশে যাচ্ছিল। সুস্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে অঞ্জলি নিবেদন ও কোলকাতা থেকে আগত মহারাজের উদ্দাত্তকণ্ঠে চণ্ডীপাঠ, যেন এক নতুন আত্মীক উত্তরণের সহায়ক হোল। সময়কে বললাম, একটু রোসো। সন্ধের পরই তো আবার বেঙ্গলী অ্যাসোসিএশনের পুজোর বিনোদন অনুষ্ঠান। সেজেগুজে মণ্ডপের দিকে যেতে যেতে পুজোমণ্ডপ থেকে আসা ঘোষকের বিনম্র আদেশ শুনছিলাম, তাড়াতাড়ি মণ্ডপে পৌঁছনোর জন্য।উদ্বোধনী সঙ্গীত ও পোর্টব্লেয়ার প্রশাসনের মাননীয় অতিথিবৃন্দের বরনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হোল। যখন উদ্বোধনী সঙ্গীতে শিল্পী গেয়ে উঠলেন,

 

          “জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী,

           চিন্ময়ীরূপে জাগো।

           তব কনিষ্ঠা কন্যা ধরণী

           কাঁদে আর ডাকে ‘মা গো’।।”

           তখন কোথায় কোলকাতা, কোথায় প্রবাস,

           ঘুঁচে গেলো যত দীর্ঘশ্বাস।

 

শ্রোতাদের অনেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে লাগলেন। রাত্রে আরও কিছু মণ্ডপে পূজো দেখে বাড়ি ফিরলাম।তখন শিশিরের আদরে আমাদের অফিস-আবাসনের শিউলি গাছটা যেন নুইয়ে পড়েছে।

এরপর একবার জামশেদপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজোতে তিনদিন উপস্থিত থাকবার এক অভাবনীয় সৌভাগ্যের অধিকারী হই। রাত্রে মিশনের মহারাজ একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোককে জামশেদপুর স্টেশনে পাঠান আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরে জানতে পারি, উনি একটি বিখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার পূর্বতন উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং বর্তমানে কয়েকটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার মালিক। উনি অকৃতদার এবং রামকৃষ্ণ মিশনের একজন একনিষ্ট ভক্ত।কিন্তু ওঁনার সহজ, সরল ও অমায়িক ব্যবহারে একজন মানুষের প্রকৃত শিক্ষার বিচ্ছুরন দর্শন করি। দিনের বেলায় পূজোর মন্ত্রচ্চারণের ভাবগম্ভীর পরিবেশ,সন্ধ্যায় বাঁকুড়া থেকে আসা সম্প্রদায়ের রামনামের শ্রুতিনাটক, আর অতিশয় সুস্বাদু প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজন ও নৈশভোজের মধ্য দিয়ে দিনগুলি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ট্রেনে আসতে আসতে তাই মন বলছিল,

 

          “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না,

           সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি”।

 

চাকরি জীবনের শেষদিকে ধানবাদে বদলি হওয়ার পর, কোলকাতার কাছে হওয়ার দরুন কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম।ধানবাদে অনেকগুলো পূজো হয়। কুমোরপাড়ার পূজোর কাঠামোগুলো দেখতে দেখতে অফিস যেতে মনটা ভাল হয়ে যেত। ওখানকার কিছু বাঙালি ভদ্রলোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ত্ব হওয়ার পর,মহালয়ার সকালে বেশ সুষ্ঠুভাবে পারলৌকিক তর্পণও প্রদান করতাম।অষ্টমী থেকে অফিস ছুটি হওয়ার দরুন, ওখানকার কিছু পূজো ষষ্টীতেই দেখে নিতাম।মণ্ডপ ও আলোকসজ্জ্যায় বেশ কয়েকটি পূজোর বেশ নামডাক আছে।কিন্তু সপ্তমীর রাত্রেও কোলকাতায় বাড়ি ফিরতে গিয়ে শান্তি নেই। কোলকাতায় পাড়ার পূজোমণ্ডপেও হেড অফিস থেকে মোবাইলে ফোন আসতো সপ্তমীতে।অফিস প্রদত্ত মোবাইল হওয়ার দরুন সুইচ অফ করেও রাখা যায় না।কিন্তু একবার, পূজোমণ্ডপে যখন হেড অফিস থেকে ফোন এলো, ঢাকিকে বললাম খুব জোরে জোরে ঢাক বাজাতে। আর আমি হ্যালো হ্যালো করে ফোন রেখে দিলাম।তবু পূজোর সুরে যেন কিছুটা হোলেও তাল কেটে গেল।আর দশমীর পরেই তো আবার অফিসে ছুটতে হতো, লক্ষ্মীপূজো শুধু স্মৃতির অতীতে রেখে।

কিন্তু চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর, পূজোর মজা এখন রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করি।শৈশবের সেই দুর্গাপূজার রেশ, বর্তমানের ডিজিটাল সুরে মিশে গিয়ে এক নতুন সুরের প্রকাশ ঘটিয়েছে। সে সুরের কোন ভাগ হয় না। মন তাই বলে,

 

“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না।

                   তোমায় বক্ষ মাঝে রাখিবো ছেড়ে দেবো না”।                   


 ** শক্তি পদ মুখোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন। 


লেখক পরিচিতি –

শক্তি পদ মুখোপাধ্যায়, ব্যাংকের  একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিক। ওঁনার লেখা কবিতা,গল্প এবং প্রবন্ধ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পাঠকদের প্রশংসা লাভ করেছে। তিন বছর আগে শক্তিপদবাবুর লেখা এবং পরিচালনায় একটি গীতিনাট্য প্রভূত সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়। ওঁনার লেখা কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ,  বর্ডারলেস, পাসএজার, মলিকুল, বেটার দ্যান স্টারবাক্‌স, ইত্যাদি  ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।

শক্তিপদবাবুর কিছু লেখা অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে, যেমন, দি ড্রিবল ড্রেবল রিভিউ, মিউজ ইন্ডিয়া, ইত্যাদি।

 

Saradiya Sur (Probondho / Feature) by Shaktipada Mukhopadhyay, Tatkhanik Bangla / Bengali e magazine Online Reading Free