“যদা যদা হি ধর্মস্য
গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানাং সৃজাম্যাহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।“
এই বাণী অনুসরণ করেই শ্রীভগবান এ পৃথিবীতে
জন্ম নিয়ে দুষ্টের দমন আর সৃষ্টের পালন করে এসেছেন। মৎস্য,কূর্ম,বরাহ,হয়গ্রীবা,নরসিংহ,বামন
ইত্যাদি অবতারের কথা আমরা সবাই জানি। শ্রীভাগবত অনুসারে সত্য যুগের অবধি ছিল পার্থিব
১৭ লক্ষ ২৮ হাজার বছর,ত্রেতা যুগের অবধি ছিল ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর, দ্বাপর ছিল ৮ লক্ষ
৬৪ হাজার বছর আর কলির অবধি মাত্র ১০ হাজার বছর-যার মধ্যে ৫ হাজার বছর এখন পর্যন্ত অতিক্রান্ত
হয়েছে। সত্য যুগে শ্রীভগবান এসেছিলেন শ্রী-হরি অবতারে,ত্রেতাতে এলেন শ্রীরাম রূপে,দ্বাপরে
এলেন শ্রীকৃষ্ণ অবতারে আর কলিতে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য রূপে। পুরাণে ধর্মকে একটি অপরূপ
সুন্দরী গাভীর আকারে বর্ণনা করা হয়েছে।এই গাভী সত্যযুগে চার পায়ে, ত্রেতা যুগে তিন
পায়ে,দ্বাপর যুগে দুই পায়ে আর কলি যুগে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ত্রেতা যুগে শ্রীভগবান শ্রীরাম অবতারে দুষ্ট
রাবণকে বধ করেছিলেন আর দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ রূপে অহংকারী-কপট কুরু বংশের বিনাশ ঘটিয়েছিলেন।
কিন্তু ত্রেতা,দ্বাপর এই দুই যুগ ধরে এক মহীয়সী নারী দুষ্টের দমন করেছিলেন। এই মহীয়সী
নারীর উপাখ্যান,যা খুব বেশি প্রচলিত নয়,তাই আজ আমরা তা নিয়েই আলোচনা করবো:
এই মহীয়সী নারীর নাম হলো বেদবতী।
বৃহস্পতি দেব এর পুত্র মহর্ষি কুশ-ধ্বজ স্বয়ং
লক্ষ্মীদেবীকে কন্যা রূপে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। এই তপস্যার ফলস্বরূপ তাঁর স্ত্রী
মালাবতী লক্ষ্মীর অংশ-রূপিণী এক কন্যা প্রসব করেন। এই কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়েই কান্নার বদলে
বেদধ্বণি করতে থাকেন। তাই তাঁর নাম হয়-‘বেদবতী’।
মাত্র ৯ বছর বয়সে বেদবতী পুষ্কর তীর্থে গিয়ে
কঠোর তপস্যা কালে দৈববাণী শুনতে পান,“তুমি জন্মান্তরে বিষ্ণুকে স্বামী রূপে লাভ করবে”।এই
দৈববাণী পাবার পর বেদবতী গন্ধমাদন পর্বতে গিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। এই সময় রাবণ তাঁর
তপস্যা স্থলে উপস্থিত হ’লে বেদবতী অতিথি-জ্ঞানে তার সেবা করেন। কিন্তু বেদবতীর রূপ-যৌবনে
আকৃষ্ট রাবণ কামাতুর হয়ে বেদবতীকে বলাৎকার করতে উদ্যত হয়। ক্রুদ্ধা বেদবতী যোগবলে রাবণের
সর্বাঙ্গ অবশ করে দিয়ে রক্ষা পান। কিন্তু এই অপমানের জ্বালায় তিনি তৎক্ষণাৎ প্রজ্বলিত
আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে রাবণকে সাবধান করে যান,“এই অপমানের
প্রতিশোধ নিতে আমি আবার ‘অযোনিজা’ কন্যা-রূপে তোর বধের কারণ হবো”।
রামায়ণের অন্যতম প্রধান নায়িকা সীতা ছিলেন
এই ‘অযোনিজা’ কন্যা। সীতার কাহিনী আমরা সবাই জানি। এও জানি,সীতাই ছিলেন রাবণ বধের কারণ।
রাবণ-বধের পর সীতার অগ্নি পরীক্ষা-কালে অগ্নিদেব
প্রকৃত সীতাকে রামচন্দ্রের হাতে অর্পণ করেন। আর ‘ছায়া’ সীতা অগ্নিদেব আর রামচন্দ্রের
উপদেশ অনুসারে নর্মদার দক্ষিণ কূলে শূলপাণিস্বর মহাদেবের নিকটে শূলপাণির গভীর জঙ্গলে
এক গুহা-তে কঠিন শিব তপস্যায় রত হন।
দ্বাপর যুগে এই ‘ছায়া’-সীতা মহারাজ দ্রুপদের
অনুষ্ঠিত যজ্ঞাগ্নিতে যোগবলে স্বয়ং আবির্ভূতা হন যাজ্ঞসেনী বা দ্রৌপদী রূপে। এবারেও
তিনি ‘অযোনিজা’ কন্যারূপে আবির্ভূতা হন।
এই দৌপদীই আবার অধর্মী কৌরব বংশের ধ্বংসের
কারণ হন।তাহলেই দেখতে পাচ্ছেন এই অসামান্যা নারী বেদবতী দুই যুগ ধরে দুষ্টের বিনাশ
করে সৃষ্টের ‘পালন’ করেছেন।
সূত্র: শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী- ‘তপোভূমি নর্মদা’
** শোভনলাল আধারকার-এরঅন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
শোভনলাল আধারকার স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।