তখন আমার আস্তানা জঙ্গলের ভিতর
নদীর ধারের বাংলো। এক সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদর মোড়া
অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ। পাহাড়ী মাকুলি নদী গিয়ে পড়ছে সুবর্ণরেখায়।
জায়গাটা কাঁকড়াঝোড়ের কাছে ঝাড়খন্ডের সীমানায়। দলমা পাহাড় থেকে ভেসে আসছে
আদিবাসীদের মৃদঙ্গ ও মাদলের দ্রিমি দ্রিমি তান। একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদক হিসেবে
আমার এখানে আসা, আদিবাসীদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে।
আমার স্ত্রী পৃথা বললো, “কিগো,
তোমার বন্ধুতো অনেকক্ষন বেড়িয়েছে। অন্ধকার হোল, এখনও ফিরলো না”। আমার বন্ধু প্রত্যূষ,
তার স্ত্রী রীনাকে নিয়ে এই সুযোগে এখানে বেড়াতে এসে এই বাংলোতেই উঠেছে। রাতে এখানে
বেশিরভাগ জায়গায় বিদ্যু্ৎ থাকে না। “সত্যিই এই কুসুম, শাল, সেগুন, মহুয়া, আর
আকাশমনিতে ছাওয়া অমাবস্যার রাতে, গা বেশ ছম্ছম্ করছে“, পৃথা বললো।
বাংলোর
কেয়ারটেকার-কাম-ম্যানেজার বিক্রম বেশ চৌখস ছেলে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে সে
বললো, বাইরে রাতে কোথাও না বেড়োতে। ভালুক, বুনো শুয়োর, এমনকি বাঘ, লেপার্ড ও হাতি
বিহারে বেড়োয় দলমা পাহাড় থেকে, আর আছে চোরা শিকারি, যারা বন্যপ্রানী ছাড়াও বিভিন্ন
দামি গাছ, যেমন, চন্দন গাছ চুরি করতে আসে। কোথাও একটা বাজ পড়লো। পৃথা চমকে আমাকে
জড়িয়ে ধরলো।
একটা বন্যপ্রাণীর করুন কান্নার
আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল দূরে কোথাও। “আর কতদিন তোমার এই কাজ চলবে?”, পৃথার আকুতি। “আরও
বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। ভালই তো লাগছে, নতুন অভিজ্ঞতা”, পৃথার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত
হতে হতে আমি বললাম। চারিদিক নিঃশব্দ, শুধু বন্যপ্রানীর আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক পাহাড়ী মাকুলি
নদীর মূর্ছনার সাথে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যূষরা একটু পরেই ফিরে এসেছিল। রীনা কপাল
থেকে কুন্তলরাশি সরাতে সরাতে বললো, “আমার তো এখানে বেশ মজাই হচ্ছে”। কিন্তু প্রত্যূষকে
খুব গম্ভীর লাগছিলো।
সকালবেলা একটা শোরগোলের মধ্যে
ঘুমটা ভেঙে গেল। দরজায় ঘনঘন ঘা পড়ছিল। ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখি প্রত্যূষ ও মানেজার বিক্রম
দাড়িয়ে আছে। প্রত্যূষ কান্নাভেজা গলায় বললো, “রীনা প্রাতভ্রঃমনে বেড়িয়ে আর ফেরেনি”।
রীনা একা একাই রোজ প্রাতঃভ্রমণে বেড়োয়, প্রত্যূষ একটু অলস এই ব্যাপারে। আমি
তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। বিক্রমও কয়েকজন লোক নিয়ে এসে পাশের জঙ্গল,
নদীর পাড় সব জায়গায় ভাল করে খোঁজাখুজি করলো। গ্রামের কিছু লোকও আমাদের সাথে সাথে
নদীর পাড়ে পাড়ে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু রীনা যেন কোথায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। জঙ্গলের
ভেতর থেকে বুকহিম করা একটা বন্যপ্রানীর ডাক শোনা যাচ্ছিলো।
আমি প্রত্যূষকে ভরসা দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দুঘণ্টা পরেও যখন রীনার কোন খবর পাওয়া গেলনা, তখন স্থানীয় থানায় খবর দেওয়া হোল। ওসি মিস্টার বাসুদেব পাত্র এসে বাংলোর সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন এবং অনুমতি ছাড়া কাউকে বাংলো ছাড়তে নিষেধ করলেন।
মিস্টার পাত্রকে আমার পরিচয়
দিয়ে বললাম, আমার ছোটখাট রহস্য উদ্ঘাটনে অভিজ্ঞতা আছে, কারণ আমি আগে প্রাইভেট গোয়েন্দা হিসেবে একটু আধটু নাম করেছিলাম।
এবার আমার নাম একটু চিন্তা করে বললেন, “হ্যাঁ, আপনিইতো সেই ব্যাংক মানেজারের খুনের কেসটা
সমাধান করেছিলেন, সেই কাকদ্বীপে। যাক দুজনে মিলে মশাই, এই কেসটার একটা হিল্লে করা
যাবে।“
চারিদিকে একটা থমথমে ভাব। গ্রামের কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা করছে। কিন্তু রীনার অন্তর্ধান রহস্য সবসময় আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রত্যূষ যেন কিছুটা থম্ মেরে গেছে। বিকেলবেলায় হঠাৎ বাসুদেববাবু এসে হাজির। বললেন “শিগ্গির চলুন”। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, উনি আমাকে আর প্রত্যূষকে জিপে করে দূরে নদীর গা বরাবর একটা জায়গার দিকে রওনা দিলেন। বললেন, যা বলার স্পটে গিয়ে বলবেন। নদীর পাড়ের রাস্তাটা যেখানে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানে গিয়ে জিপ থামলো। জিপ থেকে নেমে দেখলাম, নিচে রীনার বডিটা একটা পাথরের বোল্ডারে আটকে আছে। সামনে গিয়ে দেখলাম ,পোশাক সম্পূর্ণ এলোমেলো। বাসুদেববাবু বললেন গ্রামের কিছু জেলে রীনার বডিটা বিকেলে দেখতে পেয়ে থানায় খবর দেয়। একজন লোকাল ডাক্তার এসে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন যে, রীনার দেহান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে রীনার বাবা আর মা-ও খবর পেয়ে ঝাড়গ্রাম থেকে এসে পৌঁছেছিলেন। রীনার মা রীনার শরীরের ওপর হাত রেখে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন। আর রীনার বাবা থমথমে মুখে চোখ মুছছিলেন। ঐ অবস্তায় রীনার বডির একটা ফটো নেওয়া হোল,আর রীনার শরীর থেকে কানের দুল, বালা আর একটি আংটি খুলে একটি প্যাকেটে রাখা হোল। প্রত্যূষ কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো, “কাল রাত বারোটার পর আজ ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে ঐ আংটিটা আমি রীনার আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিলাম”। প্রত্যূষকে আমি সামলে রাখতে পারছিলাম না। সান্তনার সব ভাষা আমি হারিয়ে ফেললাম। ইতিমধ্যে থানার অফিসার এবং আমি সব কিছুর ছবি তুলে রাখলাম। বাসুদেববাবু রীনার বডি পোস্ট-মর্টেমে পাঠিয়ে দিলেন।
সন্ধ্যার সময় বাসুদেববাবু ফোনে
বললেন যে, “রীনার বাবা প্রত্যূষের নামে এফ আই আর করে গেছেন। প্রত্যূষ, রীনার পুরুষ
বন্ধুদের নিয়ে ভীষণ অশান্তি করতো। সেই কারনে হয়তো প্রত্যূষ রীনাকে হত্যা করে নদীতে
ভাসিয়ে দিয়েছে”। আমি বললাম, “পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা সম্ভব
নয়। তাছারা আমি যতদূর জানি, প্রত্যূষ রীনাকে খুবই ভালবাসতো। এমনও হতে পারে, পাহাড়ি
নদীর ধারের কোন উঁচু পাথরের টিলা থেকে রীনা পিছলে নীচে নদীতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে
যায় এবং নদীতে ভেসে যায়। আবার আত্মহত্যার ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না”। বাসুদেববাবুও
মানলেন যে আমাদের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট আসা
পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
রাত্রে ঘুম আসছিল না। পৃথাও
বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিল। খুন, আত্মহত্যা, না দুর্ঘটনা? কিছুই কূল কিনারা করতে
পারছিলাম না। পরদিন ভোরে আমি ঝাড়গ্রামে গিয়ে প্রত্যূষ আর রীনার বাবা-মার সাথে কথা
বললাম। প্রত্যূষের মা-বাবা রীনার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে অনেক অভিযোগ করলেন। আর রীনার
বাবাতো বলেই দিলেন, তিনি প্রত্যূষের বিরুদ্ধে করা এফ আই আরের শেষ দেখে ছাড়বেন। রীনার
কয়েকজন প্রাক্তন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও কথা বললাম। রীনা যথেষ্ট খোলামেলা ধরনের মেয়ে
এবং ওর অনেক পুরুষ বন্ধু ছিল। যদিও রীনার মৃত্যু খুন, আত্মহত্যা, না দুর্ঘটনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়, কিন্তু ওর
বন্ধুদের মধ্যে যারা আমার সন্দেহের তালিকায় আছে, তারা হোল, রাজনৈতিক নেতার ছেলে
অমলেশ, প্রোফেসর মানব এবং সঙ্গীত শিল্পী স্বদেশ। আর একটি চমকপ্রদ ব্যাপার জানলাম
যে, বিক্রমও রীনার একজন প্রেমিক। রীনার গয়নাগুলোর ফটো ঝাড়্গ্রামের কয়েকটি বড় দোকানে
দেখিয়ে কিছু সুত্র পেলাম। বাংলোতে ফিরে আমি বিক্রমের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম।
কিন্তু বিক্রম বললো যে, রীনার সঙ্গে অনেকদিন ধরে তার কোন যোগাযোগ নেই।
তৃতীয়দিন সকালে পোস্ট-মর্টেম
রিপোর্টে জানা গেল, গলা টিপে রীনাকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু
বেশিক্ষন জলে থাকায় আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট নয়। শরীরে অন্য কোন আঘাত বা অত্যাচারের
চিহ্ন পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টে পাওয়া যায় নি। বাসুদেববাবু বাংলোতে এসে একান্তে আমার সঙ্গে
অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। বাসুদেববাবু চলে যাওয়ার পর, প্রত্যূষ আমার ঘরে এসে
রীনার হত্যার ব্যাপারটা শুনে চমকে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে বললো, যেই এই জঘন্য কাজ করে থাকুক, আমার হাত
থেকে তার নিস্তার নেই। কিন্তু রীনার বাবার করা এফআইআরের কথা শুনে কেমন যেন গুটিয়ে
গেল। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো, সে নির্দোষ। রীনাকে সে খুব ভালবাসে। সে কক্ষনো এ
কাজ করতে পারে না। সে অবাক হয়ে আরো বলে যে, রুমে একই রকম রীনার আর একটি আংটি আজ সে পেয়েছে। আমি চমকে উঠে আংটিটা হাতে নিয়ে
গভীরভাবে পরীক্ষা করলাম।
হঠাৎ আমার যেন মনে হোল রহস্যের পর্দা খুলতে আর বোধ হয় বেশি দেরি নেই। আমি সেই আংটিটারও একটা ফটো নিয়ে রাখি। আর প্রত্যূষকে বলি, আজ যদি ওকে থানায় নিয়ে যায়, ও যেন এই আংটিটা সবার সামনে বাসুদেববাবুর হাতে তুলে দেয়। আমি দ্রুত ঝাড়গ্রামে গিয়ে একটি বড় সোনার দোকানে দ্বিতীয় আংটির ছবিটা দেখাই এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাই। ঝাড়গ্রাম থেকেই আমি বাসুদেববাবুকে ফোনে বলি, “আপনি এখুনি বাংলোতে গিয়ে প্রত্যূষকে জেরা করার জন্য থানায় নিয়ে যান। আর আজ রাতে বাংলোতে রহস্যের শেষ অঙ্কের দৃশ্য অভিনীত হবে। সাদা পোশাকে আপনার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে আপনি সন্ধ্যার মধ্যে আমার রুমে চলে আসবেন”। বাসুদেববাবু বললেন, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মশাই। আপনার কথায় এত তাড়াতাড়ি প্রত্যূষকে ধরে নিয়ে আসবো। আবার বলছেন রাত্রে রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। যাই হোক আপনি যখন বলছেন, আমি ঠিক সময় মত চলে যাব”। আমি বললাম, “আর একটা কথা। প্রত্যূষ আপনাকে একটা আংটি দেবে। আপনি সেটা বেশ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবাইকে দেখিয়ে ওর রুমেই রেখে, রুম সিল করে দেবেন”। বাসুদেববাবু বললেন, “আমার মাথায় আর কিছুই ঢুকছে না। যাই হোক আপনি যা বলছেন, সেরকমই হবে। রাখলাম”।
দুপুরবেলায় বাংলোতে
গ্রামবাসীদের বেশ ভিড়। বাংলোর সব কর্মচারীরাও দাড়িয়ে আছে। বাসুদেববাবু প্রত্যূষকে
গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছেন। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো, সে নির্দোষ। সে আরো বলে যে,
রুমে একই রকম রীনার আর একটি আংটি সে আজ পেয়েছে। আংটিটা হাতে নিয়ে বাসুদেববাবু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
দেখে ওনার সহকারীর হাতে দিলেন। সবার মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পরে গেলো আংটিটা দেখার
জন্য। বাসুদেববাবু আবার আংটিটা উঁচু করে সবাইকে দেখিয়ে, সেটা আংটির বাক্সে
রেখে,বাক্সটা প্রত্যূষের রুমেই রেখে দিলেন। তারপর রুম সিল করে বাইরে একজন প্রহরী বসিয়ে দিলেন।
রাত প্রায় তিনটে বাজে। চারিদিকে
আবছা আবছা অন্ধকার। শুক্লপক্ষের তৃতীয়ার চন্দ্রিমা, বনানীর মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে
পড়ে একটা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। চারিদিকে অবিচ্ছিন্ন ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, দূরে
কোথাও এক বন্য প্রাণীর গর্জন আর মাকুলি নদীর অবিরাম কলধ্বনি, সবকিছুই যেন এক অশনি
সংকেতের নির্দেশ করছে। আমার রুমের উল্টোদিকের রুমটাই প্রত্যূষের রুম। দরজায় প্রহরী
ঝিমুচ্ছে। আমার রুমের আলো নেভানো। আমি আর ছদ্মবেশে বাসুদেববাবু পর্দার আড়াল থেকে
কাচের জানালার সামান্য ফাঁক দিয়ে উল্টোদিকের দরজায় নজর রাখছিলাম। বাসুদেববাবু উসখুস
করছেন। চাঁপা স্বরে বললেন, “কি হোল? রাত তো কাবার হতে চললো”। “একটু
ধৈর্য ধরুন”, আমি বললাম। যদিও আমি মনে মনে ভাবছিলাম, আমার ধারনা কি তবে ভুল
হবে। কিন্তু হঠাৎ দেখি মুখোশ পরা ও আপাদমস্তক কালো পোশাকে মোড়া একজন লোক অন্ধকার
ফুড়ে এসে প্রহরীর নাকে একটা রুমাল চেপে ধরতেই প্রহরী মাটিতে ঢলে পড়লো। বাসুদেববাবু
উত্তেজিত হয়ে ওনার রিভলভারের স্ট্র্যাপে হাত দিতেই আমি ওনার হাত চেপে ধরলাম, আর
চুপ থাকতে ঈশারা করলাম। এরপর আগন্তুক খুব দ্রুত এক বিশেষ কায়দায় তালা খুলে প্রত্যূষের
রুমে ঢুকে, টর্চের আলোয় কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। আমরাও তাড়াতাড়ি দরজার দুধারে
নিঃশব্দে পজিশন নিলাম। এক একটা মিনিট কাটতে চাইছিল না। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
ঐ শীতের রাত্রেও উত্তেজনায় ঘামছিলাম। কিছুক্ষন পরে আগন্তুক টর্চ নিভিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে
আসতেই, বাসুদেববাবু লাফ দিয়ে ওকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন। ধস্তাধস্তির মধ্যে
আমি আগন্তুকের মুখোশটা টেনে খুলে দিয়ে ওর পকেট থেকে একটা বাক্সসহ আংটি হাতিয়ে নিয়ে
বললাম, “বিক্রম তোমার খেলা শেষ”।
চতুর্থদিন সকাল ছটা। থানার একটি
ঘরে বিক্রম হাতকড়া পরে মাথা নিচু করে বসে আছে। ঐ ভোরেও থানায় গ্রামের অনেক লোকের ভিড়।
বাসুদেববাবু বললেন, “আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু খোলসা করে বলবেন? আপনি কি করে
আন্দাজ করলেন!”
আমি শুরু করলাম। “রীনার এত
পুরুষ বন্ধুদের মধ্যে কাউকে, বা প্রত্যূষকে ঠিক হত্যাকারী হিসাবে ধরতে পারছিলাম
না। সন্দেহটা প্রত্যূষের ওপরেই বেশি পড়ছিল, কারণ ওদের মধ্যে রীনার পুরুষ বন্ধুদের
নিয়ে মাঝে মধ্যেই অশান্তি হোত। কিন্তু
দ্বিতীয় আংটিটা প্রত্যুষের রুমে পাওয়ার পর রহস্য আরও বেড়ে যায়। রীনার হাতে পরা যে
আংটিটা রীনার ডেডবডিতে পাওয়া গিয়েছিল, তাতে খুব ছোট করে সোনার কাজ করা ইংরাজী V এর
মধ্যে, সোনার P বসানো আছে। এটাই প্রত্যূষ রীনাকে দিয়েছিল। এটা আমার নজরে আসে। আর
একটা আংটি যেটা প্রত্যূষ গতকাল ঘরে পায়, সেটা আমি গভীরভাবে লক্ষ করে বুঝতে পারি
যে, ঐ আংটিটাতে সোনার একটি ইংরাজী V এর মধ্যে একটি সোনার B বসানো আছে। অর্থাৎ,
দুটো আংটির মধ্যে প্রত্যূষ আর বিক্রমের নামের প্রথম অক্ষর, যথাক্রমে P এবং B, V
অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইনের বক্ষে বিরাজ করছে। ঝাড়গ্রামের একটি সোনার দোকান এই বছর এই
ধরনের আংটি বিক্রি করছে, ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে। ক্রেতাদের নাম থেকে আমি
প্রত্যূষ এবং বিক্রমের নামগুলো পাই। অবশ্য বাসুদেববাবু দোকানে ফোন করে আমাকে এইসব
তথ্য দেখাবার ব্যাপারে বলার পরই, দোকানের লোকজন আমার সঙ্গে সহযোগিতা করে”।
“পুরো ব্যাপারটা আমি টোপ হিসাবে
ব্যবহার করি। পরিকল্পনামাফিক প্রত্যূষকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যেতে বলি এবং আমার
কথামত বাসুদেববাবু বিক্রমের দেওয়া আংটিটা সবাইকে দেখিয়ে প্রত্যূষের ঘরে রেখে, ঘর
সিল করে দেন। বিক্রম সমস্ত ঘটনা লক্ষ করে এবং ভীত হয়ে পড়ে। কারন বিক্রমের দেওয়া
আংটিটাই বিক্রমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এটা বুঝতে পেরে বিক্রম ঐ আংটিটা
নিজের হস্তগত করবার জন্য ফন্দি করে। প্রমান লোপাট করার জন্য বিক্রম যে ঐ রাত্রে
প্রত্যূষের রুমে রাখা আংটিটা নিতে আসবে তা জানতাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিক্রম তাই ধরাও
পড়ে যায়। তাছাড়া গ্রামের কিছু লোক বিক্রম এবং রীনাকে ভোরে নদীর পাড়ে দেখেছে। তারাও
সাক্ষ্য দেবে, দরকার পড়লে”।
আমি বিক্রমকে বললাম, “বিক্রম
এবার তুমি কি বাকিটা বলবে, নাকি বাসুদেববাবু আলাদা করে তোমায় বিশেষ জেরা করবেন?” বিক্রম
এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো, “আমি রীনাকে খুব ভালবাসি, আমি ওকে মারতে চাইনি। ওকে
শুধু আমি ভ্যালেন্টাইন ডের ঐ বিশেষ দিনে, আমার দেওয়া আংটিটা পরতে বলেছিলাম। যদিও
আগের দিন আমার দেওয়া আংটিটা রীনা রুমে নিয়ে যায়, পরের দিন পরবে বলে, কিন্তু পরদিন ভোরে
ও বলে যে, প্রত্যূষ রাত্রে ওকে একটা ভ্যালেন্টাইন আংটি পরিয়ে দিয়েছে। তাই
প্রত্যূষের সামনে আমার দেওয়া আংটিটা পরতে পারেনি। আমার দেওয়া আংটিটা ও ঘরেই লুকিয়ে
রেখেছিল। আসলে ও বুঝতে পারেনি যে, প্রত্যূষও ওর জন্য একটা ভ্যালেন্টাইন আংটি
ঝাড়গ্রাম থেকে কিনে রেখেছিল ওর অজান্তে। তারপর প্রত্যূষ রাত বারটার পরে, ঐ
সারপ্রাইস গিফ্টটা রীনার আঙুলে পরিয়ে দেয়। এখন বুঝতে পারছি রীনার কিছু করার ছিল
না। কিন্তু তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। আমাদের মধ্যে এরপর প্রবল বাদানুবাদ এবং তর্কাতর্কি
হয় এবং উত্তেজনার বশে আমার দুহাত ওর গলায়
চেপে বসে যায়। ও অজ্ঞান হোয়ে ঢলে পড়ে।
ওকে পরীক্ষা করে দেখি ওর
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না। ঐ ভোরে আমি চারিদিকে কাউকে দেখতে পাই নি। আমার দ্বারা
ঐ অনিচ্ছাকৃত খুনের ভয়ে আমি প্রচণ্ড ভীত হয়ে পড়ি এবং ভয়ে ভয়ে আমি ওকে নদীর জলে
ভাসিয়ে দেই”। এবার বিক্রমকে বাসুদেববাবু বললেন, “ঠিক আছে, বাদবাকিটা আপনি আদালতে বলবেন”।
পরদিন সকালে প্রত্যূষ এবং রীনার
বাবা এসে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে গেছেন। বাসুদেববাবুও আমার সঙ্গে দেখা করে অনেক
ধন্যবাদ দিয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে রীনার বাবা ওনার করা এফআইআর তুলে নিয়েছেন। আমাকে আরও দুদিন এখানে থাকতে হয়,
আদিবাসীদের নিয়ে প্রতিবেদনটা শেষ করবার জন্য। আমার পত্রিকার সম্পাদক আমার ওপর খুব
খুশি, কারন আমাদের পত্রিকায় প্রকাশিত “ভ্যালেন্টাইন রহস্য” -এর প্রতিবেদন পাঠকমহলে
খুব সাড়া ফেলেছে। দুদিন পর আমরা বাংলো থেকে কোলকাতার উদ্দেশে রওনা হচ্ছি। আমার
এখানকার কাজ শেষ। পৃথা আমাকে একটি স্থানীয় পত্রিকা দেখিয়ে বললো, “দেখেছ, রীনার
হত্যা রহস্যের কাহিনী বেশ ফলাও করে বেরিয়েছে”। কিন্তু আমার মন খুব খারাপ।
প্রত্যূষের জন্য, রীনার জন্য। আমাদের সাথে ওরা
যদি এখানে বেড়াতে না আসতো, তাহলে হয়তো এরকম হৃদয়-বিদারক ঘটনা ঘটতো না। বাংলোর
পরিমণ্ডল এখন বড়ই বিষাদময়। মাকুলি নদীর কলতানও যেন এক শোকগ্রস্ত রমণীর অবিরাম
ক্রন্দনরোল। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি আর পিছন ফিরে তাকাই নি।
লেখক পরিচিতি –
শক্তি পদ মুখোপাধ্যায়, বিএসসি, সিএআইআইবি,
ডিআইএম, ডিসিও, এমএ (ইংরাজি), ব্যাংকের একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিক। ওঁনার লেখা
কবিতা,গল্প এবং প্রবন্ধ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পাঠকদের প্রশংসা লাভ করেছে। তিন
বছর আগে শক্তিপদবাবুর লেখা এবং পরিচালনায় একটি গীতিনাট্য প্রভূত সাফল্যের সঙ্গে
মঞ্চস্থ হয়। ওঁনার লেখা কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ, বর্ডারলেস, পাসএজার, মলিকুল, বেটার দ্যান
স্টারবাক্স, ইত্যাদি ম্যাগাজিনে
প্রকাশিত হয়েছে।
শক্তিপদবাবুর কিছু লেখা অদূর ভবিষ্যতে
প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে, যেমন, দি ড্রিবল ড্রেবল রিভিউ,
মিউজ ইন্ডিয়া, ইত্যাদি”।
