শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় –
অপরাজেয়
কথাশিল্পী
ড. বাসুদেব রায়
জীবনের সমালোচনাকে সাহিত্য বলে , আর
গদ্যভাষায় লেখা আখ্যানধর্মী রচনাকে
বলা হয় কথাসাহিত্য । লেখক তার নিজের ব্যক্তিত্বকে সম্প্রসারিত ও প্রতিফলিত করার
সুযোগ সাধারণভাবে কথাসাহিত্য অর্থাৎ উপন্যাস ,ছোটগল্প
ইত্যাদিতে পান । কবি তার কবিতায় যে অনুভূতি ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে প্রকাশ করেন
,
কথাশিল্পী তার কথাসাহিত্যে তা সম্প্রসারিত করেন তার গল্পের
নায়ক - নায়িকা বা পার্শ্ব - চরিত্রের মধ্যে । বাংলা সাহিত্যে কথাসাহিত্য আধুনিক
যুগের পূর্বে পরিলক্ষিত হয় না । বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম দু'টি
নাম হচ্ছে – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( ১৮৩৮-১৮৯৪ ) এবং
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৬১-১৯৪১ ) । বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে এদের পরেই তার
নামটি সর্বাগ্রে আসে তিনি হচ্ছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( ১৮৭৬-১৯৩৮ ) । তাঁকে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী । বাংলা
সাহিত্যে তাঁর আগে ,তাঁর সমকালে এবং তার পরে আরও অনেক জনপ্রিয় কথাশিল্পীর আবির্ভাব
ঘটেছে ,
কিন্তু তারা কেউ শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার মাত্রাকে অতিক্রম
করতে পারেননি ।
রবি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যখন
মধ্যগগনে তখন চন্দ্রের উদয় । সেই চন্দ্র অর্থাৎ শরৎচন্দ্র । রবিতাপে ঝলসে গেল না
শরৎচন্দ্রের স্বকীয়তা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্ধশত জন্মজয়ন্তীতে শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং যে মানপত্র লিখেছিলেন , তাতে
রবীন্দ্রনাথকে সম্বোধন করে বলেছিলেন , “তোমার
প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই । " সেই কথাটি শরৎচত্র সম্পর্কেও
প্রযোজ্য । শরৎচন্দ্রের জীবনকাহিনী খুবই চমকপ্রদ । ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর (
বাংলা ৩১ ভাদ্র , ১২৮৩ ) হুগলি জেলার দেবানন্দপুর
গ্রামে তার জন্ম হয় । তাঁর পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা ভুবনমোহিনী (
মতান্তরে ভূনেশ্বরী
) দেবী । মতিলাল সাহিত্যপ্রেমী এবং পাশাপাশি সংসার সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন । ' আত্মকথা
'-য়
শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন ,“পিতার নিকট হতে অস্থির স্বভাব ও
গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত উত্তরাধিকার সূত্রে আর কিছুই পাইনি । "
শৈশবে শরৎচন্দ্র দেবানন্দপুরে
প্যারীচরণ বন্দ্যেপাধ্যায় ( প্যারী পণ্ডিত ) -এর পাঠশালায় শিক্ষালাভ করেন । তাঁর বয়স যখন দশ বছর তখন তার পিতা
ডিহরিতে চাকরি পান । তখন মা , ভাই - বোনদের সঙ্গে
শরৎচন্দ্র মাতুলালয় ভাগলপুরে বসবাস করতে
থাকেন । ক্লাশ সেভেন পর্যন্ত কোনও রকমে
পড়াশোনা করার পর অর্থনৈতিক কারণে তাকে পড়াশোনা বন্ধ করতে হয় । পরে পাঁচকড়ি
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় ১৮৯৪ সালে শরৎচন্দ্র এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন
। এরপর তিনি জুবিলী কলেজে ভর্তি হন । কিন্তু অর্থাভাবে তার পক্ষে এফ.এ পরীক্ষা
দেওয়া আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি । এতে তার মনে যথেষ্ট ক্ষোভ জমা হয়েছিল । কানপুর
প্রবাসী লেখিকা লীলারানি
গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ,) "১৪
বছর ১৪ ঘন্টা ধরে পড়ি । সেই যে একজামিন দিতে পারিনি , কেবল
সেই রাগে।“
ভাগলপুরে বিভূতিভূষণ ভট্ট এবং তার বোন
লেখিকা নিরুপমা দেবী সহ আরও অনেক সাহিত্যানুরাগীর সঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
পরিচয় হয়েছিল । এমন একটি সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে সাহিত্য রচনার পাশাপাশি বই পড়ার
প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি । সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি শরৎচন্দ্র খেলাধুলো , নাট্যচর্চা
,
বংশীবাদন , জনসেবা ইত্যাদি কাজেও
নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন ।
১৯০১ সালে শরৎচন্দ্র পিতার সঙ্গে
ঝগড়া করে গৃহত্যাগী হন । সন্ন্যাসীর বেশে কাটিয়ে দেন বেশ কিছুকাল । ১৯০৩ সালে
পিতার মৃত্যুর পর তিনি চাকরির সন্ধানে ব্রহ্মদেশ বা বার্মা ( বর্তমান মায়ানমার )
যান । এর আগে তিনি কিছুকাল ভাগলপুরে
জমি জরিপের কাজ করেছিলেন । বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে যাওয়ার আগে ছদ্মনামে লেখা
শরৎচন্দ্রে প্রথম প্রকাশিত গল্প মন্দির ( ১৯০৩ ) “কুন্তলীন ' গল্প
প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয় । তাঁর , দ্বিতীয়
গল্প ‘বড়দিদি’ ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় ' ভারতী
'
নামক সুবিখ্যাত সাহিত পত্রিকায় । উল্লেখ্য , 'বড়দিদি
'
বড়গল্প হওয়ায় অনেকে এটিকে উপন্যাসের পংক্তিভূক্ত করেন ।
এর কিছুদিন পর থেকে বাংলা সাহিত্যকে শরৎচন্দ্র অজস্র দানে সমৃদ্ধ করতে থাকেন ।
ফলস্বরূপ কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ।
১৯১৬ সাল পর্যন্ত শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় রেঙ্গুনে বিভিন্ন চাকরিতে কর্মরত ছিলেন । তারপর চাকরিতে ইস্তফা
দিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন । প্রথমে তিনি বসবাস শুরু করেন হাওড়া জেলার এক
অঞ্চলে ,
রূপনারায়ণের তীরে , মাটির ঘরে
।
কলকাতায় আসার কয়েক বছর পরেই
গান্ধীজির আকর্ষণে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদেন শরৎচন্দ্র । সাহিত্যচর্চাও চলতে থাকে
সমান তালে । হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতির পদ গ্রহণ করেন তিনি । অপর দিকে বারীন ঘোষ
,
সূর্য সেন প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ
ছিল । এরই মধ্যে কলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলে সুবৃহৎ গৃহ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন
তিনি । একটা সময় ( ১৯৩৭ সালে ) শরৎচন্দ্রের স্বাস্থ্যের বিশেষ অবনতি ঘটায়
স্বাস্থ্যোদ্ধারে তিনি
কিছুদিন দেওঘরে কাটান । অবশেষে ১৯৩৬ , সালের ১৬
জানুয়ারি ( বাংলা ২ মাঘ , ১৩৪৪ ) কলকাতায় এই অমর কথাশিল্পীর
মৃত্যু ঘটে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য
উপন্যাসগুলো হলো : পণ্ডিতমশাই ' (১৯১৪ ‘ বিরাজ
বৌ '
( ১৯১৪ ) , ' মেজদিদি (
১৯১৫ ) ,
' চন্দ্রনাথ ’ ( ১৯১৬
) পল্লীসমাজ ' ( ১৯১৬ ) ‘ অরক্ষণীয়া
'
( ১৯১৬ ) , ' শ্রীকান্ত
'
( প্রথম ) ( ১৯১৭ ) , চরিত্রহীন
’
( ১৯১৭ ) , ‘ দেবদাস (
১৯১৭ ) ,
' দত্ত ' ( ১৯১৮ ) , শ্রীকান্ত
'
( দ্বিতীয় ) ( ১৯১৮ ) , বামুনের
মেয়ে ( ১৯২০ ) ; গৃহদাহ ' ( ১৯২০
) ,
' দেনাপাওনা ' ( ১৯২৩
) ,
' নববিধান ' ( ১৯২৪ ) , “ পথের
দাবী '
( ১৯২৬ ) শ্রীকান্ত ' (তৃতীয়)
( ১৯২৭ ) , “ শেষ প্রশ্ন ' ( ১৯৩১
) ,
“ শ্রীকান্ত ' ( চতুর্থ
) ( ১৯৩৩ ) , ‘বিপ্রদাস ( ১৯৩৫ ) ইত্যাদি । আবার , তার
উল্লেখযোগ্য গল্পগুলো হলো : ‘বড়দিদি ( ভারতী,১৯১৩
) “
রামের সুমতি ' ( যমুনা , ১৩১৯ ) , ' কাশীনাথ
'
( সাহিত্য , ১৩১৯ ) , “ বিন্দুর
ছেলে ( যমুনা ১৩২০ ) , ' দর্পচূর্ণ
( ভারতবর্ষ , ১৩২১ ) , নিষ্কৃতি
(ভারত ,
১৩২৩ ) , “ বিলাসী ' ( ভারতী ১৩২৫ ) , ‘ মামলার
ফল '
( পার্বণী , ১৩২৫ ) , ' মহেশ
'
( বঙ্গবাণী , ১৩২৯ ) , ' অভাগীর
স্বর্গ ( বঙ্গবাণী , ১৩২৯ ) ইত্যাদি । উল্লেখ্য , শরৎচন্দ্র
তার রচনাগুলো ভাগলপুর , রেঙ্গুন , হাওড়া
,
কলকাতা ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে রচনা করেন ।
প্রাচীন বাংলার কথক ঠাকুরই যেন
একালে শরৎচন্দ্রের বেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । বর্ণনার পরিচ্ছন্ন প্রবাহ , চরিত্রের
অন্তরগভীরে দৃষ্টিপাত , মনের জটিল রহস্যের গ্রন্থিমোচন
সর্বোপরি হতভাগ্য নর - নারীর সমাজ - পরিবার - সংস্কারের নিত্য নিগ্রহ , সে
অশ্রু বেদনাময় জীবনের মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি , অন্য কোনও
লেখক এতটা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারেননি , না
বঙ্কিমচন্দ্র , না রবীন্দ্রনাথ । তাই তাকে দরদী কথাশিল্পী বলা
হয় । দুঃখ - হত ভাগ্যহত মানুষের প্রতি এই হৃদয়ভরা ভালোবাসা ও অগাধ সহানুভূতি
তাঁর উপন্যাস - গল্পগুলোকে আমাদের অন্তরের নিকটতর করেছে । শরৎচন্দ্র বাংলার রসিক
পাঠক এবং বিদ্বজ্জনের কাছ থেকে অপার শ্রদ্ধা - ভালোবাসা অর্জন করেছেন ।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথেষ্ট সম্মানে ভূষিত হয়েছেন । স্মর্তব্য , শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়কে তার সাহিত্য - সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন ১৯৩২ সালে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক
ডি.লিট উপাধি দেন ১৯৩৬ সালে ।
পরিশেষে বলা যায় , অপরাজেয়
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছেন
তার বিপুল সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে । কথাসাহিত্য ছাড়াও তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধাদি রচনা
করেছেন । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অনুজ লেখকের মৃত্যুতে শোকাহত চিত্তে যথার্থই লিখেছিলেন , “ যাঁহার
অমর স্থান প্রেমের আসনে , / ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে
। / দেশের মাটির থেকে নিল যাঁরে হরি / দেশের হৃদয় তাকে রাখিয়াছে
বরি ।। ”
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন।