আক্ষেপ
নিত্যরঞ্জন দেবনাথ
সুকান্ত পুরকায়েত । সত্তর পেরিয়ে একাত্তর বছরে পা দিলেন । কদিন ধরে খুব খাটুনি যাচ্ছে । গ্রামের বাড়িটাকে আবার নতুন ভাবে সাজিয়ে তুলছেন । এখনো অনেক কাজ বাকি । পুরোনো বাড়ি । পঞ্চাশ বছর তো হবেই । তার উপর দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে বাড়িটা ফাঁকা পড়ে ছিল । থাকার কেউ নেই । নানা জায়গায় সিমেন্ট বালি খসে পড়ছে । দেওয়ালের কিছু কিছু অংশ ইট আলগা হয়ে গেছে । রাজমিস্ত্রি লাগানো হয়েছে । গত পনের দিন ধরে লেবার মিস্ত্রি মিলে আটদশ জন কাজ করে চলেছে । আর হয়তো দু - তিন দিন লাগবে । তারপর পুরো বাড়িটা রং করাতে হবে । যা জীর্ণাবস্থা ছিল । তার উপরে পুরো বন জঙ্গলে ভর্তি । এই ঝোপঝাড় পরিস্কার করতেও ছয়জন করে লেবার পুরো দুটো দিন । লাগল । পূর্ব পুরুষের ভিটে । তার জন্ম ভিটে । দেখেই আঁৎকে উঠেছিল । এবাড়িতে থাকা কি সম্ভব । খুব কষ্ট হচ্ছিল। যেখানে ছোট থেকে বড় হয়েছে । লেখাপড়া শিখেছে । তার পৈত্রিক ভিটে । সেই ভিটের এমন । ভগ্নাবস্থা দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল ।
এতদিনে বাসযোগ্য
করা গেছে । রং করার পর সে নিশ্চিত , আগের অবস্থায়
ফিরে আসবে ।
তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন , বাকি জীবনটা গ্রামের বাড়িতেই কাটাবেন । তার জন্মভূমিতে । যে বাড়িতে তার গর্ভধারিণী ও জন্মদাতা পিতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন । এটাই তার শেষ ইচ্ছা ।
কলকাতায় বালিগঞ্জ প্লেসে তার নিজস্ব বড় তিনতলা বাড়ি রয়েছে । থাকার লোক নেই । প্রতি তলায় ষোলশো স্কোয়ার ফিটের করে দুটো আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট । সব মিলিয়ে ছয়টি ফ্ল্যাট । একটি নিজের জন্য রেখে বাকি পাঁচটা ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া আছে । কখনো - সখনো কলকাতায় গেলে যাতে থাকতে পারেন তার জন্যই রাখা । অথবা সুদূর আমেরিকা থেকে একমাত্র ছেলে - বৌমা যদি আসে কখনো — তারাও থাকতে পারবে । যদিও আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ । সুকান্তবাবুর সবে ধন নীলমণি একটিমাত্র সন্তান । আমেরিকায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে । বম্বে আই.আই.টি. থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমেরিকায় চাকরি নিয়ে চলে যায় । আমেরিকা নাকি তার ভালো লেগে গেছে । এদেশে ফেরার ইচ্ছে নেই । জন্মভূমি — এসব ব্যাকডেটেড কথা শুনে নাকি তার হাসি পায় ।
চাকরি পাওয়ার পর
দুবার মাত্র কলকাতায় আসে । তাও মায়ের জোরাজুরিতে । প্রথমবার দশদিন এবং
দ্বিতীয়বার বারোদিনের জন্য । দ্বিতীয়বার যখন আসে ,তখনই এক সুন্দরী
শিক্ষিতা মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় । বাবা মায়ের ছেলের প্রতি একটা
দায়িত্ব তো একটা থাকে । সুকান্তবাবু এবং তার স্ত্রী সুতপা আগে থেকেই মেয়েটিকে
পছন্দ করে রেখেছিলেন , ছেলেরও পছন্দ হয়ে গেল বলে বিয়েটা তাড়াতাড়ি
সম্পন্ন করা গেছে । বৌমাও আমেরিকায় গিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে । তারও নাকি
দেশটি খুব পছন্দ । তাই বিদেশেই থেকে গেল । তাদের একমাত্র সন্তান অর্থাৎ সুকান্তবাবুর
নাতী এখন ডাক্তার । লস এ্যাঙ্গেলসে থাকে । সে আবার মেম বিয়ে করেছে । নাত বৌও নাকি
ডাক্তার । নাতী , নাতবৌকে তিনি চাক্ষুস দেখেন নি । কমপিউটারে ফেসবুকে
দেখেছেন । টেলিফোনে অবশ্য কথা হয়েছে কয়েকবার । ইদানীং আর টেলিফোন করা হয়ে ওঠে
না । সুকান্তবাবু নিজে থেকে না করলে ছেলে কখনো করে না । সুকান্তবাবুরও আর ইচ্ছে
হয় না । ইচ্ছেটাই যেন মরে গেছে । বছর খানেক হল স্ত্রী গত হয়েছেন । স্ত্রী গত
হওয়ার পর তিনি আর কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না । একাকিত্ব যেন বেশি করে চেপে বসেছে
। একরকম অবসাদে ভুগছেন । মনে হয় বেঁচে থাকাটাই যেন বিরম্বনা।
একদিন কি ভেবে
হঠাৎ করে চলে এলেন গ্রামের বাড়িতে । দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর । এতদিন কোন যোগাযোগ ছিল
না , বাবা মা গত হওয়ার পর প্রয়োজন বোধও করেন নি । সবকিছু
যেন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল । দিদি,বোনদের সঙ্গেও
সামান্য একটা কারণে সম্পর্কের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল । সেও আর খোঁজ খবর করেননি
। যোগাযোগ রাখেননি । হঠাৎই মনটা উতলা হয়ে উঠল। মনে হলো ওরা কেমন আছে জানা দরকার ।
ভেতরে একটা তাগিদ অনুভব করছিলেন । যদিও বোনদের বিয়ে হয়েছে অনেকটা দূরেই । ছোটবোন
অবশ্য কাছেই থাকে,কাটোয়া শহরে । ওর গ্রামের বাড়ি থেকে বাসে
ঘন্টাখানেকের রাস্তা । ইচ্ছে করলেই দেখা করা যায় । এসব ভেবেই চলে এলেন নিজের
জন্মস্থানে । বাড়ি দেখে হতাশ । তার পৈত্রিক ভিটের এই অবস্থা ! ঝোপ জঙ্গল,সাপ খোঁপের বাসা ,যেন এক প্রাচীন
ভগ্নস্তুপ । বিষন্ন মনে ফিরেই আসছিলেন । কি
ভেবে তার ছেলেবেলার বন্ধু অর্ণবের বাসায় গেলেন । বাল্যবন্ধু অর্ণব সুকান্তকে
পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। তারও বয়েস হয়েছে । তবু বন্ধুকে সে ছাড়বে না । বাল্যসুহৃৎকে
দেখে সুকান্তও যেন আবেগবিহ্বল।
বন্ধুর বাড়িতেই
একটানা সাতদিন কাটিয়ে দিলেন তিনি । এই সাত দিনেই এক নতুন জীবনের স্বাদ পেয়ে
গেলেন । বাঁচার স্বাদ , বাঁচার আকাঙ্খা বেড়ে গেল । বাল্যবন্ধুদের মধ্যে
কয়েকজন অবশ্য বেঁচে নেই । যারা আছে তাদের সঙ্গেই এই কদিন চুটিয়ে আড্ডা দিলেন ।
এই বন্ধুদের দেখে তার একরকম ঈর্ষা হয় । লেখাপড়া হয়ত বেশীদূর করেনি । ছোটোখাটো
ব্যবসা , চাষবাস বা নানা পেশায় যুক্ত । তবে এটা জোর দিয়ে বলা
যায় এরা তার থেকে অনেক সুখে আছে , ভালো আছে। ছেলে ,বৌমা ,নাতী - পুতি
নিয়ে ভরা সংসার । তাদের অভিভাবক হয়ে বটগাছের মত এদের উপর ছাতার মতন রয়েছে ।
সংসারের প্রাচুর্য হয়তো নেই , কিন্তু মনে সুখ
আছে , শান্তি আছে , আনন্দ আছে । তখনই
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন । গ্রামের বাড়িতেই বাকি জীবনটা কাটাবেন ।
বন্ধুদের বাড়িতে থেকেই বাড়ির কাজে হাত দিয়ে দিলেন । কাজ প্রায় শেষ । আর হয়তো
দু-তিন দিন লাগবে ।
তারপরেই পাকাপাকি ভাবে নিজের বাড়িতে থাকবেন । সারাদিন ধরে মিস্ত্রিদের সঙ্গে থেকে
তদারকি করে যাচ্ছেন । পরিশ্রম আছে তবু অবসাদ থেকে যেন মুক্তি পেতে চলেছেন । কত
কথাই না মনে পড়ছে । অনেক বন্ধুই তাকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াচ্ছে । আজ যেমন দুপুরে
এক বন্ধুর বাড়ি খাওয়া - দাওয়া করে এসে ছাদে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন । ডিসেম্বর মাস
। শীতকাল । মাথার উপরে সূর্যের আলো । বেশ আরামই লাগছে । কিছু পুরনো ফটো রোদে
শুকাচ্ছেন । তার মায়ের ফটো , বাবা মায়ের এক
সঙ্গে ফটো , স্যাতসেতে ড্যাম্পের জন্য কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে । মায়ের ফটোটা হাতে নিয়ে বসে আছেন ।
ভাবছেন । পুরনো কিছু স্মৃতি মনের মণিকোঠায় স্পষ্ট জ্বল জ্বল করছে । প্রায়
পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কিছু ঘটনা , যেন মনে হয় এই তো
সেদিনের ঘটনা ।
**********
গত কালই ফোনটা
পেয়েছিল সুকান্ত । বাল্যবন্ধু অর্ণবের ফোন । গ্রামের চঞ্চলবাবুর বাড়ি থেকে ফোনটা
করেছিল । মায়ের খুব অসুখ । যায় যায় অবস্থা । মা সুকান্তকে একবার দেখতে চেয়েছেন।
সুকান্ত ঠিক করেছিল , আজ বৃহস্পতিবাব , কাল শুক্রবার
অফিস করে বিকেলের দিকে বাড়ি যাওয়ার ট্রেন ধরবে । শনি,রবি
ছুটি — তাই দু'দিন গ্রামের বাড়িতে থাকাও যাবে
। স্ত্রী সুতপাকে সেই ভাবে বলেও রেখেছিল ।
পরদিন শুক্রবার ভোর
ছটায় আবার অর্ণবের ফোন– তোর মা কোমায়
আছন্ন হয়ে আছেন । কথা বন্ধ হয়ে গেছে । কাউকে চিনতে পারছেন না । তুই সকালের ট্রেন
ধরে চলে আয় ।
আরও অনেক কথাই
বলল অর্ণব । সুকান্ত নীরবে শুনে গেছে । কোন কথা বলেনি । কী বলবে ? বলার মতো মুখ নেই
যে । গ্রামের একটি বাড়িতেই টেলিফোন আছে । গ্রামের জমিদার বাড়িই বলা যায় । সেই
বাড়ি থেকে আবার ফোন করেছে মানে ,মায়ের শরীর সত্যিই খুব খারাপ ।
শুনে মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিল । তাই তড়িঘড়ি হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা । খেয়েই
বেরিয়ে পড়েছে । হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল সাতটা পাঁচ মিনিটের হাওড়া - বর্ধমান
মেইন লাইন লোকাল ধরে বাড়ি যাচ্ছে। একটুর জন্য কর্ড লাইনের ট্রেনটা বেরিয়ে গেল ।
কর্ড লাইনে গেলে অন্তত আধঘন্টা আগে বর্ধমান পৌঁছাতে পারত । মন চঞ্চল । মাকে কি
দেখতে পাবে ! কেন যে সে গতকাল গেল না । অর্ণব যা বলল , একমাস ধরে মা
বিছানা নিয়েছেন । উঠে বসার ক্ষমতা নেই । বিছানায় শুয়ে - শুয়েই সব কিছু করাতে
হচ্ছে । পায়খানা , পেচ্ছাব সব । এতটা বাড়াবাড়ি ভাবেনি সে । গত সপ্তাহে
বাবার একটা চিঠি পেয়েছিল । বাবা লিখেছেন। তোমার মায়ের শরীর ভালো নেই । তোমাকে
একবার দেখিবার জন্য চিত্ত অস্থির হইয়া উঠিয়াছে । পত্র পাওয়া মাত্র তুমি শীঘ্রই
বাড়ি আসিবে । আশাকরি তুমি তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করিবে । ইত্যাদি ইত্যাদি ।
সুকান্ত তেমন
গুরুত্ব দেয়নি । এমন চিঠি আগেও কয়েকবার পেয়েছে । যদিও বাবার লেখা চিঠি এই প্রথম
। ছোটবোন মায়ের হয়ে লিখে দিত । ইনিয়ে বিনিয়ে শুধু অসুখের কথাই বেশি করে লিখতো
। গতকাল সকালে অর্ণব যখন ফোনটা করে সুতপা কাছেই ছিল । সুতপা বলল , তোমার মায়ের এমন
কিছু হয়নি । বলে ঐরকম । এর আগেও তো ভীষণ অসুখ বলে কত চিঠি পেয়েছ । গিয়ে দেখবে
কি ? কিছুই হয়নি । সব বাহানা ।
বাহানা কথাটা
শুনে খুব রাগ হয়েছিল সুকান্তর । রেগে গিয়ে কিছু বলতেও যাচ্ছিল । থেমে গেছে ।
অশান্তি করে লাভ নেই । কথায় কথা বাড়ে ।
সুতপা আবার বলল , একবার যখন
যাওয়ার কথা বলেছে যেতে তোমাকে হবেই । না হলে বারবার চিঠি দিয়ে ফোন করে বিরক্ত
করবে । শুক্রবার অফিস করে শনিবার সকালে বেরিয়ে যাও। একদিন মায়ের আদর খেয়ে এসো ।
সুতপার কথাবার্তাই
ঐরকম । বাঁকা বাঁকা । সোজাভাবে কথা বলবে না । আসলে মাকে ঠিক পছন্দ করে না বলেই বোধহয়
এমন তির্যক কথাবার্তা,ঠেস দিয়ে বলা । সুকান্ত সব হজম করে
যায় । নীরব থাকাই শ্রেয় । অশান্তি এড়ানো যায় । আগে অনেকবার হয়েছে । সাতদিন , দশদিন কথাই বন্ধ
ছিল দুজনের মধ্যে । বাড়িতে দুটি প্রাণী তাও যদি কথা বন্ধ থাকে তবে কেমন লাগে । এসব কথা আবার কাউকে বলাও যায়না । উভয়
সংকট । তার চেয়ে মৌন থাকা ভালো নয় কি? যদিও এর আগে
মায়ের অসুখের কথা বলে অনেক চিঠিই পেয়েছে । কিন্তু গিয়ে দেখে মা দিব্যি ভালো
আছেন । রান্না - বান্না করছেন । সুকান্ত যেসব খেতে ভালোবাসে সেইসব আটদশ রকম আইটেম
রান্না করে ফেলেছেন । একমাত্র ছেলেকে তৃপ্তি করে খাওয়াবেন বলে এমন অসুখের কথা
লিখে ছেলেকে কাছে আনা । সুকান্ত কি বলবে? এক - একবার মনে -
মনে রাগও হয় । আবার ভাবে মা তার সন্তানকে একবার চোখের দেখা দেখবার জন্য কত রকম মিথ্যার
আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনই তার অপদার্থ সন্তান । এসব ভেবে মনের ভিতরটা হু হু
করে ওঠে । কান্না পায় মায়ের জন্য।তারও তো মন কেমন
করে । মায়ের হাতের রান্না খেতে খুবই লোভ হয় । তবু যেন হয়ে ওঠে না । মায়ের
রান্নার স্বাদই আলাদা । এমন কিছু কিছু আইটেম আছে যেন সাড়া
পৃথিবীতে আর কেউ এমন রান্না করতেই পারবে না । অপূর্ব স্বাদ । মুখে লেগে থাকে । ভোলা যায় না । হাজার অর্থ দিলেও এমন রান্না পাওয়া যাবে না । সুকান্ত একবার
মাকে বলেছিল , তুমি অসুখ বলে খবর পাঠাও কেন ? – চিন্তা হয় না ?
মা বলেছিলেন , অসুখ না বলে অন্য
কিছু লিখলে তুই কি আসবি ? ছ'মাস হয়ে গেল , বাড়ি আসার নামও
করিস না । বাবা-মাকে কি দেখতেও ইচ্ছে করে না ?
সুকান্ত বলেছিল , তোমাদের খোঁজখবর তো
নেওয়াই হয় । প্রতি মাসেই তো চিঠি লিখি।
মা রেগে
গিয়েছিলেন । চিঠি লিখেই দায় সারতে চাইছিস ? ছোট থেকে তিল তিল
করে মানুষ করলাম । বড় করলাম । কেমন আছিস স্বচক্ষে না দেখলে মন উচাটন হবে না ? আরও নানা কথা
শুনিয়ে দিয়েছিলেন – তুই তো সন্তানের বাবা হয়েছিস । সন্তানকে কাছ ছাড়া
করে কদিন থাকতে পারবি ? শুনে সুকান্তর মনটা কেমন করে উঠেছিল । সত্যিই তো
এমনভাবে তো সে কখনো ভাবেনি । তবে বাবা - মায়ের জন্য তার কষ্ট অনুভব হয় । একসঙ্গে
থাকতে না পারার কষ্ট । সেই অনুভব তার একান্ত নিজের । কাউকে শেয়ার করা যাবে না ।
স্ত্রী সুতপাকে তো নয়ই ।
ছুটির দিনগুলোতে
এত ব্যস্ত থাকে , সময়ই পায় না । অফিসের কিছু না কিছু কাজ থাকে , তার উপর সংসারের কাজ । সংসারি হয়ে গিয়ে এত জড়িয়ে পড়েছে তা বলার নয় । দিন দিন আরও ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে । বিয়ের পর প্রথম
প্রথম প্রতিমাসে বাড়ি যেত । একাই যেত । বাবা মা শুধু নয় , পাড়া -
প্রতিবেশী , বন্ধু - বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ আড্ডা দিয়ে এলে
যে কিআনন্দ পাওয়া যায়, বলার নয়।
একঘেয়েমি জীবন থেকে একটু মুক্তি । মুক্ত খোলা আকাশ
থেকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন প্রাণভরে নিয়ে আসা । শুধু খোলা আকাশই
নয়, গ্রামের মানুষের প্রণোচ্ছাস আন্তরিক ভালোবাসার যে
অক্সিজেন তার মূল্যও অপরিসীম ।
ট্রেন মেমারিতে
ঢুকল । বর্ধমান পৌছুতে আরো কম করে আধঘন্টা । বহন থেকে বাসে করে আবার যেতে হবে বলগোনা
। তাতেও প্রায় এক ঘণ্টার উপর রাস্তা । বলগোনা থেকে ভ্যান
- রিক্সায় আরও তিন কিলোমিটার ভেতরে যেতে হবে । পুরোটাই কাঁচা রাস্তা । তার মানে
সুকান্তর বাড়ি যেতে এখনও প্রায় দেড় - দু'ঘন্টা । আর যেন
তর সইছে না । হঠাৎ করে মায়ের জন্য এত কষ্ট হচ্ছে ,বুকের ভেতরটা
কেমন করে উঠছে । কেমন এক ছটফটানি শুরু হয়ে গিয়েছে । মায়ের সঙ্গে দুটো কথা বলতে
না পারলে স্বস্তি হবে না । খুব দেখতে ইচ্ছে করছে । কথা বলতে মন চাইছে ।
ঘড়িতে এখন আটটা
বেজে কুড়ি মিনিট । আকাশে রোদ ঝলমল করছে । তবু বেশ শীত শীত ভাব। ডিসেম্বর মাস ।
সম্ভবত বাংলায় অগ্রহায়ণ । শীত থাকারই কথা । ভাগ্যিস সোয়েটারটা
পরে এসেছিল । কলকাতায় অত ঠান্ডা না থাকলেও গ্রামের বাড়িতে প্রচন্ড ঠান্ডা ।
গ্রামে শুধু সোয়েটারে হয় না । আরো কিছু চাপাতে পারলে ভালো
হয় ।
ট্রেন শক্তিগড়
ঢুকল । অনেক যাত্রী হুড়মুড় করে নেমে যাচ্ছে । ট্রেনটা এখন অনেকটাই ফাঁকা । আর মাত্র মাঝখানে একটা স্টেশন– গাংপুর । তার
পরেই বর্ধমান ।
সুকান্তর উসখুস
ভাবটা কমছে না । বাড়ি না যাওয়া অবধি স্বস্তি নেই । নানা বিক্ষিপ্ত ভাবনা মনের
মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে । স্থির হয়ে বসে থাকতে
পারছে না । সুতপাকে জোর করে নিয়ে এলেই বোধহয় ভালো হত । সুতপা কেন যে মাকে ঠিক
পছন্দ করে না বোঝে না । একবার কোলকাতার বাড়িতে দিন সাতেকের জন্য মাকে নিয়ে
এসেছিল । তিনদিন থাকার পরই মা আর থাকতে চাইলেন না । বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির
হয়ে উঠেছিলেন । কেন তা আজও অজানা । সুকান্ত সুতপার কাছে জানতে চেয়েছিল,মা চলে যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন । কেন ?
-
আমি জানতে চাইছি , তোমার সঙ্গে
মায়ের কিছু হয়েছে কিনা ।
সুতপা কেমন
গম্ভীর হয়ে বলেছিল – না কিছু হয়নি ।
-
তোমাকে কত করে অনুরোধ করলাম , মাকে একটু সঙ্গ
দিও । এই প্রথম ছেলের বাসায় এলেন । মাত্র সাতদিন থাকবেন । মায়ের কাছে থেকে একটু
হাসিমুখে কথা বললেই হবে, তাতেই মা খুশী। শুনলে না । দু'একটা দিন অফিস থেকে ছুটি নিতে বলেছিলাম , তা তো নিলেই না ।
উপরন্তু রবিবার ছুটির দিনটায় চলে গেলে বাপের বাড়ি । রবিবারটা অন্তত মায়ের সঙ্গে
সারাটা দিন কাটাতে পারতে !
সুতপা রেগে গিয়ে
যা বলেছিল । তা ভয়ানক । সুকান্ত শিউরে উঠেছিল । সুতপা বলেছিল— দেখো
ঐ রকম লোক দেখানো নাটক আমার দ্বারা হবে না । আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি – ঐ মহিলাকে
সারাক্ষণ সঙ্গ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় । ওনার অযৌক্তিক উপদেশ আমি মানতে রাজি
নই । তাছাড়া ঐ সব সাব - স্ট্যান্ডার্ড মহিলাকে মা,মা, বলে ডাকতেও পারব না ।
আরো কি সব বলে
যচ্ছিল – সুকান্ত ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিল না । এসব কথা না শুনলেই বোধহয় ভালো হতো । এক অব্যক্ত যন্ত্রণা । কাউকে বলাও
যাবে না । সারারাত একবিন্দু ঘুমোতে পারেনি । পরদিন সকালেই
মাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল ।
দোষটা অবশ্য
সুকান্তর নিজের । বাড়ির অমতে বিয়ে করাটাই তার মস্তবড় ভুল । নিজে একজন
ইঞ্জিনিয়ার । একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে । ভালো বেতন । বিয়েও করে
নিজে পছন্দ করে । এক চাকুরিজীবি মেয়েকে । বিশাল বড়লোকের একমাত্র আদরের কন্যা ।
তার শ্বশুরবাড়ি কোলকাতার উপর রাজপ্রাসাদম অট্টালিকা । শ্বশুর নামী শিল্পপতি ।
একমাত্র মেয়ে কেমিষ্ট্রিতে এম.এস.সি. পাশ করে চুপচাপ বসে থাকবে ? তাই সখের চাকরি
করে । সুকান্তর এক বন্ধুর মাধ্যমে সুতপার সঙ্গে প্রথম আলাপ । আলাপ থেকে বন্ধুত্ব -
প্রেম ভালোবাসা । তারপর বিয়ে । অপরদিকে সুকান্ত, তার বাবা
একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারী । কেরানির চাকরি করতেন । অজ গ্রামে বাড়ি । বাড়ি
বলতে মাটির বাড়ি । গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছায়নি । ছেলেকে ধার দেনা করে হোষ্টেলে রেখে
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন । ছেলেকে পড়াতে গিয়েই বাবা নিঃস্ব । তার উপর এই চাকরি
থেকেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন । সামান্য বেতন থেকেই এসব করতে হয়েছে।
আগে ঘরের
মেয়েদের পড়াশুনার চল তেমন ছিল না । বিশেষ করে গ্রামে - গঞ্জে তো ছিলই না। তাই
সুকান্তর মা'ও লেখাপড়া জানতেন না । অবশ্য বাড়িতেই বাবা অক্ষর
জ্ঞান করিয়েছিলেন । নাম ঠিকানা কোনরকমে লিখতে পারতেন । বাবা ম্যাট্রিক পাশ ছিলেন
। মা লেখাপড়া জানলেও সংসার চালনায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল । অন্তত সুকান্ত তাই মনে
করে । বাস্তব বোধও যথেষ্ট ছিল । পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ক্ষমতাও ছিল । তবু
কেন যে সুতপার সঙ্গে মিল হয়নি সুকান্তের কাছে আজও তা বোধের অগম্য।
আসলে সুকান্তর
প্রেম ভালোবাসা করে বিয়ে করাটাই কাল হয়েছে । বাবা - মা ভালোভাবে নিতে পারেন নি ।
সুকান্তের প্রতি বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল অগাধ । ছেলেকে বড় ইঞ্জিনিয়ার করাবেন ।
গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে । বিশাল বেতনের চাকরি করবে তখন আর পায় কে । মাকে বলতেন , তখন অভাব বলতে
কিছু থাকবে না গো। অভাব পিছনের দরজা দিয়ে ছুটে পালাবে ।
বাবা-মায়ের
সেই তৃপ্তিপূর্ণ অবয়ব এখনও চোখে ভাসে । মনে আছে , চাকরি পাওয়ার পর
, প্রথম মাসের মাইনে যখন পেল , বাবার সেকি
উচ্ছ্বাস— বলিস কিরে ? আমার অফিসের বড়
সাহেবও তো অত টাকা মাইনে পায় না । তুই ঢুকেই অত টাকা ! কত পরিকল্পনা । পাকা বাড়ি
হবে । দোতলা বাড়ি । গ্রামে তখন একটি মাত্র পাকা বাড়ি আছে । তাও একতলা । দ্বিতীয়
বাড়িটি হবে সুকান্তদের । উপর নিচ মিলে আট দশটা বেডরুম , এ্যাটাচ বাথরুম ।
বারান্দা , ডাইনিং, কিচেন আরও কত কি
! ছেলে , ছেলের বউ স্বাধীনভাবে দুটো ঘর নিয়ে থাকবে । দুই
মেয়ে , জামাই , তাদের ছেলেমেয়ে
নাতিপুতি ঘর তো অতগুলো লাগবেই । কাগজ - কলম নিয়ে ঘরের নকশা কতবার যে হলো । ভাবলে
কেমন অনুশোচনা হয় । বাবার ইচ্ছে পূরণ হলো না । সুকান্তর বিয়ের পরই বাবা যেন কেমন
হয়ে গেছেন । কেমন উদ্যমহীন , নিষ্প্রভ , ম্রিয়মান । তখন থেকেই
ছেলের কাছ থেকে তেমন কিছু আশাও তিনি করেন নি । পাকা বাড়ি একটা হয়েছে ঠিকই । তবে
একতলা । সুকান্তই করেছে ।
এখন ভাবে ,মানুষ জীবনে এমন
কিছু ভুল করে বসে , তার খেসারত সারাজীবন ধরে দিতে হয়। শোধরানোর অবকাশ
থাকে না । ছোট্ট বেলায় এই অভাবের সংসারেও ভাইবোন মিলে কত সুখী ছিল তারা । গ্রাম্য
পরিবেশে মানুষ । বাবা,মা,ভাই,বোনের মধ্যে যে একাত্মবোধ ছিল । তার সুখানোবোধই আলাদা । মনে পড়ে সন্ধের
পর সব ভাইবোন মিলে হ্যারিকেনের আলোয় একসঙ্গে পড়তে বসত । মা মুড়ি আর তেলেভাজা
আলাদা আলাদা বাটিতে করে প্রত্যেককে দিত । কত আনন্দ করে তৃপ্তি করে খাওয়া হত ।
সেসব দিন কত সুখের ছিল !
কিন্তু আজ ? আজ আর নেই । কেন
নেই ! বড় হয়ে গেছে বলে ! নাকি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে! এসব খুঁটিনাটি
ভাবনা অহরহ আসে । যদি সে বাবা মায়ের পছন্দ করা কোন গ্রাম্য শিক্ষিতা মেয়েকে
বিয়ে করত , হয়তো বা ভালো হত । গ্রামের মাটির ঘরেও বাবা,মা,সকলকে নিয়ে মিলেমিশে দু - চারদিন অন্তত থাকতো,মানিয়ে
নিত । যেটা সুতপার পক্ষে সম্ভব নয় । একেবারেই নয় । যে ছোট থেকে এয়ার কন্ডিশন
ঘরে থেকে বড় হয়েছে ,তার পক্ষে লাইট ফ্যান ছাড়া
থাকা অসম্ভব । মাটির ঘরকে তো ঘর বলেই মনে করেনা
। এতে সুতপাকে কোন মতেই দোষ দেওয়া যায় না । মানুষ অভ্যাসের দাস। সুকান্ত নিজেও
এখন এয়ার কন্ডিশন ঘরে থেকে অভ্যস্ত । কারণ অফিস এবং কলকাতার নিজের বাসায়ও A.C. রয়েছে । বলতে
খারাপ লাগে , তারও গ্রামের বাড়িতে এলে অস্বস্তি হয় । গরমে কষ্ট
হয়। যদিও বছর খানেক হল দেশের বাড়িতে ইলেক্টিরে কানেকশান নেওয়া হয়েছে । লাইট,ফ্যান
লাগানো হয়েছে । তবু প্রায় সময়ই কারেন্ট থাকে না ।
সুকান্ত বাবাকে
বলেছিল , বাড়িটা দোতলা করা হোক । দোতলার ঘরে A.C. মেশিন লাগানো হোক
। বাবা রাজি হয়নি । ভাবখানা এমন ,কি হবে । অত বড়সড় বাড়ি করে ? থাকবে কে ? ভবিষ্যতে কে
দেখবে এসব ?
আসলে সুকান্তের
প্রতি বাবা মায়ের একটা অভিমান আছে । বিয়ের আগে নিজের পছন্দের কথা বাবা,মা
শুনে আঁতকে উঠেছিলেন । নানারকম ভাবে সুকান্তকে বুঝিয়েছিলেন । একমাত্র কারণ
দুর্বলতা । সুতপার প্রতি দুর্বলতা । সুতপাকে সে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছিল । তার
থেকে সরে আসা সম্ভব ছিল না । তখন উভয়ে - উভয়কে পাগলের মতো ভালোবাসে । তখন কারো
বাধাই মানা যেত না ।
-কি দাদা নামবেন
না ? ট্রেন বর্ধমান ঢুকে গেছে ।
এক ভদ্রলোকের
কথায় সুকান্তর সম্বিত ফিরে এল । হন্তদন্ত হয়ে ট্রেন থেকে নামল । সুকান্ত দেখল ঘড়িতে এখন ন'টা বেজে দশ মিনিট । ওভারব্রীজ
পেরিয়ে , প্লাটফর্ম পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সে । তার পরিচিত
জায়গায এটা । ছোট থেকে পরিচিত । যেন নিজের
দেশ । এর একটা আলাদা সুখ আছে । এই সুখানুভূতির এক আলাদা উপলব্ধি । রবিঠাকুর
বলেছিলেন । চিনলাম বিদেশে গিয়া । সত্যিই তাই। জন্মভূমির টানই আলাদা ।
-যাবেন নাকি বাবু
? রিক্সা লাগবে ? এক রিক্সাওয়ালা
সামনে এসে দাঁড়িয়ে ।
সুকান্ত রিকশায়
উঠে পড়ল – তিন কোনিয়া বাস স্ট্যান্ড চলো ।
এটা কি মাস ? সূর্যের উজ্জ্বল
আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে । ঠান্ডা ভাবটা আর নেই । বরং একটু গরম গরম লাগছে । বাস
স্ট্যান্ডে এসে দেখে পরপর দুটো কাটোয়া যাবার বাস দাঁড়িয়ে আছে। কন্ডাকটারকে
জিজ্ঞাসা করল ।
- কটায় ছাড়বে
দাদা ?
-এক্ষুনি ছাড়বে । উঠে পড়ুন ।
টিকিট কেটে কন্ডাকটার বলল নিন ।
সুকান্ত টিকিট
কেটে জানলার ধারে একটা সিটে বসল । কিছুক্ষনের মধ্যে বাস ছেড়েও দিল । ওকে নামতে
হবে বলগোনা । বলগোনাটা বর্ধমান কাটোয়ার মাঝামাঝি জায়গায় । ঠিকমতো চললে চল্লিশ
মিনিটের বেশী লাগার কথা নয় । সেখান থেকে আবার তিন কিলোমিটারের মত ভ্যান রিক্সায়
যেতে হবে । কুড়ি পঁচিশ মিনিটের মত লাগে । ঘড়িতে এখন
দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি । অর্থাৎ এগারোটার আগে কোন মতেই বাড়ি পৌঁছতে পারছে না
। মাকে কি অবস্থায় যে দেখবে সেই চিন্তায় অস্থির । সম্ভব হলে কলকাতায় নিয়ে চলে
আসবে । কোন বড় নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে দেবে । এ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে আসার কোন
অসুবিধাই নেই । ডাক্তারের সঙ্গে আগে কথা বলে নিতে হবে । এখন
যদি সুকান্ত গিয়ে দেখে মা দিব্যি ভালো আছেন,আগের মত রান্নাবান্না করছেন। ওঃ ভগবান তাই যেন হয় ।
বাস দ্রুতগতিতেই
চলছ । এক্সপ্রেস বাস । কয়েকটা স্টপেজ পেরিয়েও গেছে । দু'ধারে সারি সারি
ধানের ক্ষেত । তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা । কোথাও দু'চারটে বাড়িঘরও
আছে । ধান কাটা চলছে । তার মানে এখন অগ্রহায়ণ মাস । এই সময়টাতেই ধান কাটা শুরু
হয় । এমাসেই ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব । নতুন ধান ওঠার সময় প্রত্যেক চাষীর ঘরেই ঘটা
করে নবান্ন হয় । খাওয়া - দাওয়ার এলাহি ব্যাপার । যাদের জমি জায়গা নেই তারাও এই
উৎসবটা পালন করে । সুকান্তদের বাড়িতেও জাঁকজমক করেই হত । নানা রকম আইটেম মা
রান্না করতেন । পুরানো দিনের এমন অনেক উৎসব শহরে আজকাল আর হয় না । আজকালকার মেয়ে
বৌ-রা এসব জানেও না । জানলেও করতে চায়
না । এই শীতকালটা এলে বিশেষ করে পৌষ সংক্রান্তিতে কত রকমের পিঠেপুলি খাওয়া হত ।
সুকান্ত এসব ভুলতে চলেছে । সুতপা আদৌ নিজে করতে পারে কিনা সন্দেহ , পারলেও আগ্রহ নেই
। তবে সুতপার হাতের রান্নাটা ভালো । কিছু কিছু আইটেম এত ভালো রান্না করে যে তোফা খেতে লাগে । যদিও রান্না করে কদাচিৎ । বরাবর রাঁধুনিই করে । এক আধ
দিন ছুটির দিনে ইচ্ছে হলে রান্না ঘরে ঢোকে । যেমন সুকান্ত
ফুলকপি দিয়ে মুগডাল খেতে খুব ভালোবাসে । সেটা সুতপাই করে । অথবা ইলিশ মাছের ভাপা। যেদিন বাজার থেকে ইলিশ মাছ আনা হবে , সেদিন সুতপা
রান্না ঘরে ঢুকে যাবে সুকান্তর জন্য ভাপা ইলিশ করতে । এমনিতে মায়ের সঙ্গে এমন
ব্যবহার করলেও সুকান্তকে এখনও সুতপা সমান ভালোবাসে । অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছে ।
এই যেমন ক’দিন আগে , সুকান্তর বেশ
জ্বর হলো । সাতদিনের মত ভুগতে হয়েছে । সুতপা পুরো সাতদিন ছুটি নিয়ে সুকান্তকে
সেবাযত্ন করল। ডাক্তারকে কল দেওয়া , ঔষধপত্র আনা সব
নিজেই করল । একদিন জ্বরটা এক’শ তিন ডিগ্রির
উপর উঠে গিয়েছিল । মনে আছে,তা দেখে সুতপা
কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল । ডাক্তারকে বারবার কল করা , সারাক্ষণ কপালে
জলপট্টি দেওয়া । কত কি যে করেছিল , ভাবা যায় না ।
চোখে মুখে আতঙ্ক , কেমন উৎকণ্ঠায় ছিল ।
হঠাৎ খেয়াল হল ,মায়ের এত শরীর
খারাপ ,বাড়িতে কেন রেখে দিয়েছে ? অন্তত বর্ধমান
হাসপাতালে নিয়ে গেল না কেন ! অর্ণবকে জিজ্ঞেস করা হল না । এখন আর টেলিফোন করে
জানা সম্ভব নয় । গ্রামে একটি বাড়িতে মাত্র টেলিফোন আছে । চঞ্চলবাবুর বাড়িতে ।
অবস্থাপন্ন বনেদি পরিবার , টেলিফোন তখন বিলাসিতা । তাছাড়া বিশাল খরচেরও ব্যাপার
আছে । যদিও সুকান্ত কলকাতায় নিজের বাসায় টেলিফোনের কানেকশান নিয়েছে । একমাত্র
সুতপার তাগিদে । মেইনলি ওর বাবা - মার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যই নেওয়া ।
অর্ণব বলেছিল , গ্রামের শ্যামল
ডাক্তার দেখছেন । উনি নাকি পাকাপাকি ভাবেই গ্রামে থেকে যাবেন , সিদ্ধান্ত
নিয়েছেন । শ্যামল । ব্যানার্জী মেডিসিনে এম.ডি. , অনার্স । ভালো
নামি ডাক্তার ,কলকাতারই এক বড় হসপিটালের মেডিসিনের হেড অফ দা
ডিপার্টমেন্ট ছিলেন । বেশ নাম ধাম আছে ।
রিটায়ার করার পর বড় বড় নার্সিংহোমের সঙ্গে এ্যাটাচ ছিলেন । ওনাকে দেখাতে হলে
একমাস আগে নাম বুক করতে হতো । সেই শ্যামল ডাক্তার শিকড়ের টানে শেষ বয়সে গ্রামে
চলে এসেছেন স্থায়ীভাবে । গ্রামের বাড়িতে থাকবেন বলে । শ্যামল ডাক্তারের এক ছেলে
ও এক মেয়ে । ছেলেটি বিদেশে থাকে ,বোষ্টনে । খগপুর
আই.আই.টি. থেকে এম.টেক , করে ভালো অফার
পেয়ে বিদেশ চলে যায় । মেয়েও ভালো চাকরি করে । এখন স্বামীর সঙ্গে দিল্লীতে আছে ।
শ্যামলাকাকা কাকিমাকে নিয়ে গ্রামেই কাটাবেন বলে স্থির করেছেন । কলকাতায়ও নিজস্ব
বাড়ি আছে । সব ছেড়ে চলে এসেছেন । নামমাত্র ভিজিট নিয়ে গ্রামের মানুষের সেবা করে
চলেছেন ।
গ্রাম থেকে মানুষ শহরে যায় । লেখাপড়া , উচ্চশিক্ষা , চাকরি - বাকরির জন্য শহরে যেতেই হয় । নিজেকে আরো উন্নত করতে । সুযোগসুবিধা তো সব শহরেই। গ্রামে কি আছে ? তাই মানুষ শহরমুখী হয় । থাকতে থাকতে একটা সময় শহরেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায় । গ্রামকে ভুলতে বসে । নিজের জন্মস্থান , ছেলেবেলা যেখানে কেটেছে, স্মৃতিতে তাছাড়া থাকলেও যোগাযোগের অভাবে এক সময় বিলীন হয়ে যায় । শেষ বয়সে বোধহয় জন্মভূমির টান নতুন ভাবে নাড়া দেয় । শ্যামল ডাক্তারের যেমন হয়েছ ।
সুকান্ত
যখন পৌঁছল , তখন বাড়ি ভর্তি লোক
। পাড়াপ্রতিবেশী অনেকেই রয়েছে । সুকান্তর বুকটা ধক করে উঠল । তবে কি অঘটন ঘটে
গেছে ? সুকান্ত সোজা মায়ের ঘরে ঢুকল ।
মা ,মা মাগো আমি এসে
গেছি । তুমি কেমন আছো ? সকলে অবাক হয়ে দেখছে । যে মানুষটা কোমায় আচ্ছন্ন
ছিল , আট - দশ ঘন্টা ধরে স্থির দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়েই
থাকতেন । চোখের পাতা পর্যন্ত পড়ে না । বাকরুদ্ধ ছিলেন । কথা বলার ক্ষমতা ছিল না ।
সুকান্তকে দেখে তিনিই নড়েচড়ে উঠেছেন । বাবা বলে মুখে স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন ।
করেই সুকান্তর হাতটা শক্ত করে ধরেছেন । ধরার পরই সব শেষ । প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল
। সুকান্ত হতভম্ব ! একি হলো । বাড়িতে কান্নার রোল শুরু হয়ে যায় ।
বড়দি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন , ভাই তুই এত দেরী
করলি কেন ? কদিন ধরে সারাক্ষণ মা শুধু তোর নামই করে যাচ্ছিলেন ।
মায়ের শরীরে
প্রাণ নেই । অথচ সুকান্তর হাতটা এখনো মা শক্ত করেই ধরে আছেন ।
ছোট মাসী বললেন , তোর জন্যই দিদি
এতক্ষণ বেঁচে ছিলেন । শেষ সময়ে দিদি তোকে দেখার জন্য আকুলি - বিকুলি করছিলেন ।
কথা বলতে চাইছিলেন । তুই এসে দিদির সাধ পূর্ণ করলি ।
সুকান্তর এখনও বোধগম্য
হচ্ছে না । মা মরে গেল ! যেন অবিশ্বাস্য । বাবা এককোণে বসে ফোঁপাচ্ছেন। বাবা একা হয়ে গেলেন । সুকান্ত ভাবতে পারছে না ,এমন কি করে হলো ? মায়ের বয়স তো
এমন কিছু নয় ! সবে পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন হবে ,এই বয়সে মানুষ
মরে যায় !
শ্যামল কাকা
বললেন , তোর মাকে রাজরোগে ধরেছিল রে । এ রোগ সারার নয় ।
কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করেও জীবন ফেরানো যেত না । আর ধরা পড়ল এমন সময়ে তখন অনেক
দেরি হয়ে গেছে । সারা শরীরময় ছড়িয়ে গেছে । তাই তোর বাবাকে বললাম তোকে শীঘ্রই
খবর দিতে । এক্ষুনি যেন চলে আসিস । তোর ভাগ্য ভালো , তোর মাকে শেষ
দেখা দেখতে পেয়েছিস । মা ও তোকে দেখে শান্তিতে যেতে পারল ।
তার কি ভাগ্য ভালো
সুকান্ত বুঝে উঠতে পারছে না । ছোটবোন কৃষ্ণা ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । সুকান্তকে
বলল , “তুই এত পাষাণ কি করে হলি রে দাদা ? মা তোকে এতবার
করে খবর পাঠালো , তোকে দেখতে চাইছে , আর তুই এলি না ? বিয়ে করে মাকেই
ভুলে গেলি ? বাড়ি আসাই বন্ধ করে দিলি ? যে মা তোকে
আমাদের থেকে শতগুণে বেশী ভালোবাসতো , ভালো জিনিসটা
লুকিয়ে তোকেই খাওয়াত । আদর করত , তার মর্ম তুই
বুঝলি নারে দাদা । তোর জন্যই মা - টা মরে গেল । ” বলে হাউমাউ করে
কান্না শুরু করে দিল ।
সুকান্ত জোড় ধাক্কা খেল। এই দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর পরেও বোনের কথাটা বার বার মনের অন্তস্থলে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। একই কথার প্রতিধ্বনি অহরহ শুনতে পাচ্ছে ।
ছোট বোন কৃষ্ণা , সুকান্তর বিয়ের
ছ'মাস আগে এই বোনের বিয়ে হয়েছিল । বিয়ের পর সত্যিই
বাড়ি আসা একদম কমেই গিয়েছিল । সুকান্তর ভেতরে কেমন কাঁপুনি শুরু হয়েছে । মায়ের মৃত্যুর জন্য কি সেই দায়ী ! শেষ বয়সে এসে একই
ভাবনা তাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে । একরকম পাপবোধে ছটফট করছে , পাপের ফলেই কি
তার আজ এই অবস্থা ! নিঃসঙ্গ , একাকি জীবন
কাটাতে হচ্ছে । পুত্র , পুত্রবধূ , নাতী - পুতি সব
আছে, অথচ থেকেও যেন নেই । পৃথিবীতে তিনি
একা ।
বাবার কথা মনে
পড়লে কষ্ট হয় । মা ছাড়া বাবা অসহায় । কেমন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন । মায়ের
মৃত্যুর দেড় বছরের মাথায় বাবাও চলে গেলেন । শেষ বয়সে বাবা নিঃসঙ্গ জীবন
কাটিয়েছেন । একাকিত্বের যন্ত্রণায় অকালেই বাবাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হল ।
যেন মনে হয় এর মূলে সে নিজে । এর জন্য সুকান্ত সম্পূর্ণ দায়ী । আগে কেন এমন
ভাবনা আসেনি । এখন কেন আসছে ? রক্তের তেজ কমে গেছে
বলে কি ? বয়েস হয়েছে বলে ? ........
- একি দাদু তুমি এই অন্ধকারে ছাদে বসে আছো ? ঠান্ডা লাগছে । ? ঠান্ডায় কত শিশির পড়ছে! টের পাচ্ছো না ? কাজের মেয়ে কুসুমের কথায় সুকান্তর সম্বিত ফিরে এল । কখন বিকেল হয়েছে , সন্ধে নেমেছে টেরই পায়নি । কুয়াশা পড়ছে , বেশ শীত শীতও লাগছে । অন্ধকারে চোখ ঝাপসা । চোখের জলে গাল দুটো ভিজে গেছে । সুকান্ত টেরই পায়নি । ভাগ্যিস কুসুম অন্ধকারে দেখতে পায়নি । দেখলে অস্বস্তিতে পড়ে যেত । কুসুম পাড়ারই মেয়ে । রান্নাবান্না , ঘর গোছানোর কাজে কুসুমকে রাখা হয়েছে । সকাল থেকে সারাদিন থাকে । রাতের রান্না করে বাড়ি চলে যায় । তাছাড়া কে আছে ওর । ওরাই এখন আপনজন । এদেরকে নিয়েই তো থাকতে হবে ।
কুসুমকে বলল , “তুই এই ফটো দুটো
আর এই বই তিনটে নিয়ে নিচে যা । চায়ের জল বসা । আমি আসছি । ”
আকাশে অনেক তারা উঠেছে । বেশ কিছু তারা জ্বল জ্বল করছে । বেশ তেজি ,শক্তিশালী মনে হচ্ছে । যেন যৌবনে টগবগ করছে , কাউকে পরোয়া করে না । আর কিছু আছে টিম টিম করে জ্বলছে । নিঃষ্প্রভ, ম্রিয়মান । অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল । বয়েস হয়েছে হয়তো । যে কোন সময় অক্কা যাবে । কেউ চেয়েও দেখবে না । কারো কিছু আসবে যাবেও না । আরেকটি তারা তার বদলে নতুন এসে স্থান গ্রহণ করবে । আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে । বলবান হয়ে উঠবে । জগতের নিয়মই বোধহয় তাই । আসা যাওয়া কাজ না হলে ভারসাম্য বজায় থাকবে কি করে ! পৃথিবীতে এলে তাকে তো বিদায় নিতেই হবে । অত ভাবলে চলে !
সুকান্ত নিচে
নামার জন্য পা বাড়াল , এককাপ চা খেয়ে তাকে আবার বেরুতে হবে । রাতে এক
বন্ধুর বাড়িতে নেমতন্ন আছে । তাড়াতাড়ি যেতে হবে । বন্ধুরাই তো ওর সব । জীবনের
সাথী । ওর আর ভাবনা কি !
লেখক পরিচিতি:
জন্ম পৈত্রিক
বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী
জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।
তাঁর প্রথম
গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল
সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য,
শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট, দৈনিক
স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর ৩৬৫ দিন এবং লিটল
ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।
তিনটি গল্প সংকলন
ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও
সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।