Advt

Advt

তিন বন্ধু (গল্প) , কর্ণেল (ডাঃ.) প্রণব কুমার দত্ত, Three Friends (Story) by Col. Dr. Pranab Kumar Dutta, Tatkhanik Bengali Magazine Online Reading Free

Three Friends (Story) by Col. Dr. Pranab Kumar Dutta, Tatkhanik Bengali Magazine Online Reading Free


স্কুল ও কলেজ জীবনের আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে তা বেশ অনেক  বছর হয়ে গেল । আমি যখন ডাক্তারি পড়ি তাদের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বেশী সহপাঠীরা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে । মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় আমরা চারজন খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলাম তারা হোল অপূর্ব রক্ষিত , মলয় ব্যানার্জী , করুণা স্যান্যাল ও আমি । কলেজে আমাদের চারজনকে অনেক মাস্টারমশাইরা মজা করে ফোর মাসকেটিয়ার্স বলে সম্বোধন করতেন। আমি ছাড়া ফোর মাসকেটিয়ার্স - এরমধ্যে তিন বন্ধুই ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বিলাতে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য চলে যায় । ফলে আস্তে আস্তে আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় । তবুও পুরান দিনগুলির কথা মনে হলে আমার যে আজও ভাল লাগে তা বলাই বাহুল্য । আমি পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করে প্রায় তিনদশকের বেশী দেশের নানা জায়গা ঘুরে ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে ফৌজি চাকরী থেকে অবসর গ্রহণ করি । আশির দশকের গোড়ার দিকে ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটা জায়গায় বেড়াতে গেছিলাম তখন জম্মুর কাছে একটা কোর হেড কোয়াটর্সে আমি পোস্টেড ছিলাম । যাই হোক আর্মি থেকে সাড়ে তিন মাস ছুটি নিয়ে প্রথমে লন্ডনে পৌঁছালাম । উদ্দেশ্য ছিল বিদেশ দেখা এবং আমার পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ স্থাপন করা । লন্ডনে দু - দফায় প্রায় আড়াই মাসের মতো ছিলাম ।

এবারে আমার তিন বন্ধুদের সম্বন্ধে কিছু বলবো । অপূর্ব ছিল বেনারসের ছেলে । ও ছিল অসম্ভব আমুদে , রসিক , বুদ্ধিমান ও খিস্তিবাজ ছেলে । ওর উপস্থিত বুদ্ধির অসংখ্য অভিজ্ঞতা আমাদের কলেজ এবং পরবর্তী জীবনে দেখেছি ওর রসিকতা এবং উপস্থিত বুদ্ধির সব উদাহরণ দিলে একটা বই লিখে ফেলা যায় । আপাতত আমি দু একটা অভিজ্ঞতার কথাই বলব । ১৯৫৭ সালে আমাদের কলেজের হাসপাতালের একটা আউট পেশেন্ট ব্লক ( O.PD. ) উদ্বোধন করতে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় । মুখ্যমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন কলেজ অধ্যক্ষ ডাঃ কে . এন . বাগচী এবং হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট ডাঃ মহেন্দ্র সরকার । এদের দুজনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সিস্টার টিউটর,একটা রূপার রেকাবীতে একটা কাঁচি নিয়ে উদ্দেশ্য যে মুখ্যমন্ত্রী সিসটার টিউটরের ধরা রেকাবীর থেকে কাঁচি নিয়ে নতুন O.PD. Block -এর দরজার ফিতে কাটবেন এবং প্যান্ডেলে বসা সমবেত শিক্ষক ও ছাত্ররা করতালি দেবে । মুখ্যমন্ত্রী গাড়ী থেকে নামা মাত্র অপূর্ব হঠাৎ সিসটার টিউটরের হাত থেকে রেকাবীটা তুলে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে কাঁচিটা এগিয়ে দিল এবং যথারীতি মুখমন্ত্রী ফিতা কাটলেন। ফল হল পরদিন কলকাতার সব দৈনিক পত্রিকাতে ছবি বেরলো মুখ্যমন্ত্রীর পাশে অপূর্ব রক্ষিত দাঁড়িয়ে । এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অপূর্ব ঘটিয়েছিল দিল্লীতে দুবছর পরে । আমি তখন দিল্লীর AIIMS - এ চাকরী করি এবং আমার দাদা তখন ললিতকলা আকাদেমিতে সহসচিবের পদে কাজ করতেন । দিল্লীর All India Fine Arts & Crafts Society ( AIFACS ) - এর গ্যালারিতে বার্ষিক জাতীয় প্রদর্শণীর উদ্মাটন করতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু । আকাদেমির সম্পাদক মিঃ বরদা উকীল আমার দাদাকে বলেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ীটা আসামাত্র ওঁর গাড়ীর দরজাটার বাইরে থেকে খুলে পন্ডিত নেহরুকে অভ্যর্থনা জানাতে । আমি আর অপূর্ব একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি আসার অপেক্ষায় । হঠাৎ দেখি অপূর্ব উধাও । আমার দাদাকে সরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী গাড়ির দরজাটা অপূর্বই খুলে দিল । তখন নিরাপত্তার এত কড়াকড়ি ছিল না । পরের দিন দিল্লীর সব সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে অপূর্বর ছবি । ও সেবার ৩ / ৪ দিন আমার সঙ্গে AIIMS -এর হোস্টেলে ছিল । এর মধ্যেই আমার অবাঙালী সহকর্মীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে গেছিল ।  

এর পরে বলবো দ্বিতীয় বন্ধু করুণা প্রসাদ সান্যালের কথা । ও ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছিল এবং মামার বাড়িতে থেকে বড় হয়েছিল । ওঁর মামা ডাঃ মৈত্র ছিলেন শারীর বৃত্ত বৈজ্ঞানিক। উনি মেডিকেল কলেজ থেকে Physiology-তে অনার্স এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে M.Sc.-তে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন । আশানুরূপ ভাবে ইনি জীবনে কৃতকার্য হতে পারেন নি । পেশাদারী জীবনে ব্যার্থ হয়ে উনি রাজনীতিতে যোগদান করেছিলেন । তবে সেখানে সফল হননি । ওর মামাকে মাতুল বলে করুণা সম্বোধন করত । রাজনীতিতে যোগদান করে বিভিন্ন স্তরে নির্বাচনে লড়াই করেছিলেন এবং সবকটাতেই ওর গচ্ছিত টাকা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হোত । কলেজ জীবনে ফাস্ট ইয়ার থেকে করুণা সব বন্ধুদের গজেন বলে সম্বোধন করত, যে জন্য ওর সহপাঠীরা সবাই ওকে গজেন বলেই ডাকত । গজেনের মামার ছেলেরা খুব উপযুক্ত হয়েছিল । বড় মামাতো ভাই ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক এবং মেজভাই ছিল ভারতীয় নৌ সেনাবাহিনীতে কমান্ডার । একবার মেজদার জাহাজ INS Delhi ১৯৫৬ সালে কলকাতায় দুদিনের জন্য এসেছিল । আমরা ৩/৪ জন বন্ধু ঐ সময়ে ঐ জাহাজে গিয়ে অনভিজ্ঞের মত একটু নেশা করে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম । সে ঘটনা মনে পড়লে আজও আমার হাসি পায় । গজেন আমার থেকে বছর দুয়েক বড় হলেও ও ছিল বুদ্ধিদীপ্ত , সুদর্শন চেহারা ও ভালো ইংরেজী বলতে পারত । গজেনের ডাক্তারী পড়াটা আমার কাছে একটা রহস্য ছিল । ওর নিজের একজন বড় ভাই ছিল। উনি সামান্য চাকরী করতেন , তার পক্ষে গজেনকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার প্রশ্ন উঠত না । ও মামার বাড়িতে হাওড়ার রামরাজাতলাতে থাকত সেখান থেকে রেল এবং ট্রামের মান্থলি কেটে ( Monthly ) কলেজে যাতায়াত করত । আমাদের কাছে মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা ধার করত ঠিকই কিন্তু সময় মত ও ধারের টাকাটা মিটিয়ে দিত । ওর জামাকাপড় ছিল সবার থেকে ধোপদুরস্ত । ওর সঙ্গে St. Paul's কলেজে L.Sc. পড়ত কেষ্ট বলে ওর এক Marine Engineer বন্ধু । কেষ্ট এবং ওর মেজদা ওকে কদাচিৎ আর্থিক সাহায্য করত বলে আমার ধারণা । ওঁর সব থেকে বড়ো গুণ ছিল যে সবসময়ে ও ছিল সদা প্রফুল্ল । সেজন্য আমরা ২ / ৩ জন ছাড়া কেউ ওর দুঃস্থ অবস্থার কথা জানত না । ডাক্তারী পাশ করার পরে কলকাতাতে খুব ভালো সুযোগ না থাকায় গজেন মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালের মেডিকেল কলেজে এ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে ১৯৫৮ সালে অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করে । উদ্দেশ্য ছিল চাকরী করে কিছু টাকা পয়সার জোগাড় করে বিলেতে চলে যাবে । ভূপালে থাকাকালীন বিখ্যাত সাংবাদিক তরুণ ভাদুড়ীর সঙ্গে ওঁর পরিচয় এবং পরে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছিল । উনি তখন অভিশপ্ত চম্বল " বইটা লিখে খ্যাতি লাভ করেছিলেন । তাছাড়াউনি বাংলা এবং ইংরাজীতে কয়েকটা বই লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন । ওঁর মেয়ে হোল খ্যাতনামা অভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ী ( অধুনা বচ্চন ) এবং জামাই বিখ্যাত চিত্রাভিনেতা অমিতাভ বচ্চন । তরুণ ভাদুড়ী,গজেনকে খুব ভালবাসত । গজেন বিলেতে যাবার আগে আমাকে লিখল খিদিরপুর ডক্ থেকে একটা কার্গো বা মালবাহী জাহাজে বিলেত যাবে। তরুণ ভাদুড়ী ওকে বিদায় জানাতে কলকাতাতে দুদিনের জন্য আসবেন । গজেন আমাকে অনুরোধ করল যে পারলে আমি যেন ঐ সময়ে কলকাতায় আসি । ওর অনুরোধ আমি উপেক্ষা করতে পারিনি । তখন আমি চাকরী করি আর্মিতে নাগাল্যান্ডের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম - মেলুড়িতে (Mclur ) পোস্টেড । যথাসময়ে আমি কলকাতাতে পৌছলাম এবং গজেনের সাথে দেখা করলাম। আমি গজেনকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ও কি করে কার্গো মালবাহী জাহাজে বিলাত যাবার ব্যবস্থা করল ? গজেন আমাকে জানাল যে আমাদের কলেজের বন্ধু সোমনাথ সিংহ রায়ের মেজকাকা স্যার বিজয় প্রসাদ সিংহরায় ( Sir B. P ) তখন ছিলেন India Shipping Corporation এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর । স্যার বি পি ওকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন । তখন ঐ কোম্পানীর কয়েকটা মালবাহী জাহাজ ইউরোপে যেত ; এরকম দু - একটা জাহাজে সাত - আট জন প্যাসেঞ্জার নেবারও বন্দোবস্ত থাকতো । ঐ জাহাজে গেলে এক হাজার থেকে বারশ টাকার মত খরচ হতো । যাই হোক গজেনের বিলাত যাবার আগের দিন তরুণ ভাদুড়ী , গজেন , সোমনাথ দা ও আমি ঘন্টা তিন চার শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে আড্ডা মেরেছিলাম । পানীয় এবং মোগলাই খাবারের দৌলতে আমাদের আড্ডাটা খুব জমে উঠেছিল । তরুণদা শুধু বিখ্যাত সাহিত্যিক বা গল্প লেখকই ছিলেন না উনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আড্ডাটা জমিয়ে দিলেন । 'অভিশপ্ত চম্বল ' বইটা লেখার ব্যাপারে উনি চম্বল উপত্যকায় ডাকাতদের আড্ডায় গিয়ে এদের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন সে অভিজ্ঞতার কথাও বললেন । উনি ভূপালে  Statesman পত্রিকার বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন । ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের বিশদ বিবরণ লিখে খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন । ওঁর সাংবাদিকতার জন্য পরবর্তী জীবনে কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছিলেন । ঐ দিন আড্ডাতে ওঁর বড় মেয়ে জয়ার অভিনয় ক্ষমতা সম্বন্ধে গল্প করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে জয়া যদি অভিনয় পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে চায় তাতে উনি কখনও বাধা দেবেন না । যাই হোক পরদিন গজেনকে আমি ,তরুণদা ও সোমনাথ দা খিদিরপুর ডকে গিয়ে বিদায় জানিয়ে এসেছিলাম। পরে জানিয়েছিল যে ও বিলেতে গিয়ে একটা হাসপাতালে যোগদান করে । গজেন চিঠি লিখেছিল,তার মর্মার্থ ছিল যে জাহাজে জুয়া খেলা জিতে প্রায় অর্ধেকের পর ওর ভাড়ার টাকা উদ্ধার করেছিল । ও ছিল আমুদে এবং সদা হাস্যময় ওর কথা তাই মাঝে মধ্যে প্রায়ই মনে পড়ে ।

এবারে তৃতীয় বন্ধু মলয় ব্যানার্জীর সম্বন্ধে কিছু লিখবো । মলয় আমাদের এক বছর আগে ডাক্তারীতে ভর্তি হয়েছিল । B.Sc. পড়া শেষ করতে গিয়েও এক বছর ডাক্তারীতে ড্রপ দেয় । বয়সে দু - তিন বছরের বড় হলেও ও ছিল খুব স্নেহশীল এবং অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন । ওর বাড়ী ছিল হাওড়ার কদমতলা এলাকায় । প্রথম বছরে বাড়ী থেকে কলেজে আসত । শেষ তিন - চার বছর ও হোস্টেলে থাকত । জয়েন্ট ফ্যামিলীর বড় ছেলে হবার দরুণ ও সব বন্ধুবান্ধবদের খেয়াল রাখত । আমি , গজেন , মলয় ও অশোক বসাক ফার্স্ট ইয়ারের ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা দিয়ে ১০ দিনের জন্য পুরী ও গোপালপুর বেড়াতে গেছিলাম । মলয় এবং অশোকের বাবা দুজনেই রেলের অফিসার ছিলেন । তার জন্য এরা রেলের পাশ পেত এবং তার সঙ্গে থাকত । অ্যাটেনডেন্টের ( Attendent ) পাশ । মলয় এবং অশোক ফার্স্ট ক্লাসে আর আমি ও গজেন গেলাম থার্ড ক্লাসে - Attendent বা পরিচারক হিসাবে । চেকার মজা করে বলেছিলেন যে আপনারা ঐ দুই সাহেবের বন্ধু না পরিচারক ? গজেন ঐ একটা সিগারেট খাইয়ে বলেছিল যে আমরা সবাই একসঙ্গে কলেজে পড়ি । ভদ্রলোকের সেই হাসি আজও আমার মনে পড়ে । মলয়ের সঙ্গে আমরা হোস্টেলে পড়াশুনা করতাম । যে জন্য আমাদের বন্ধুত্বটা গভীর ছিল । এক এক সময় আমাকে বড়ভাই হিসাবে শাসন করত । যাই হোক ডাক্তারী পাশ করে একসঙ্গে আমরা ডাঃ লাহিড়ীর ওয়ার্ডে কাজ করতে আরম্ভ করি । কিন্তু মাস তিনেক পরে আমি দিল্লীতে AIIMS -তে যোগদান করি । পরবর্তী জীবনে মলয় বিলাতে গিয়ে MRCP পাশ করে । সেখানেই  ভিয়েতনামের এক নার্স মহিলাকে বিয়ে করে । ওরা দুজনেই মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরের Mission হাসপাতালে যোগ দেয় । ফিজিসিয়ান এবং কার্ডিওলজিষ্ট হিসাবে মলয় পরে সুখ্যাতি অর্জন করে । ওর মত জনপ্রিয় চিকিৎসক এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মধ্যপ্রদেশে তখন খুব কমই ছিল। দুর্ভাগ্যবশত ও নিজেকে অবহেলা করেছিল এবং নব্বই দশকের গোড়ার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় । আর্মি ছাড়ার আগে আশির দশকের শেষের দিকে কলকাতা থেকে পুনা যাবার পথে আমার সঙ্গে বিলাসপুর স্টেশনে দেখা করতে এসেছিল । ও আমাকে অনুরোধ করেছিল একদিন ওদের সঙ্গে দুটো দিন কাটিয়ে যেতে । কিন্তু এই অনুরোধ না রাখতে পারার জন্য আজও আমার অনুতাপ হয় । ওর আমার প্রতি ভালোবাসার আরেকটা উদাহরণ দেবো । ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে আমার বিয়ে হোল । আমার ভগ্নিপতি তখন হাওড়া জেলার ডিস্ট্রিক্ট ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসার ( DFPO ) মলয়ের মামাত ভাই ঐ অফিসেই চাকরী করত । মলয় তখনও বিলাতে। আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে ও আমার জন্য একটা সুন্দর সোয়েটার এবং আমার স্ত্রীর জন্য একটা দামী পারফিউম ওর ভাইয়ের হাত দিয়ে উপহার পাঠিয়েছিল । এই বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তা কি ভোলা যায় ?

এই তিন বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে প্রায় পাঁচ দশকের উপর । প্রথমে বলি অপূর্বর কথা । ১৯৫৮ সালে আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাই । তারপরের বছর আমি আর্মির চাকরীতে যোগদান করি । আর অপূর্ব বিলাতে চলে যায় ১৯৬০ সালে তারপরে আমাদের যোগাযোগ ছিল না । ১৯৮১ সালে প্রায় তিন মাসের জন্য লন্ডনে গেছিলাম । বার কয়েক ফোনে যোগাযোগ হলেও সামনাসামনি দেখা হয় নি । অপূর্ব অনেক করে আমাকে অনুরোধ করেছিল ওর বাড়িতে যেতে কিন্তু কার্যকারণে তা আর সম্ভব হয়নি । কলকাতায় বন্ধু - বান্ধবদের কাছে শুনেছি যে দশ বছর আগে ওর একটা স্ট্রোক হয় । তারপর থেকে ও বাড়ী থেকে বেরোত না এবং বাড়ীর মধ্যেই ও হুইলচেয়ারে ঘুরত । বছর কয়েক হোল ও মারা গেছে । ওর স্ত্রী ছিল একজন ইংলিশ মহিলা । লন্ডনে থাকাকালীন ১৯৮৩ সালে আমি গজেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি । লন্ডনে সেবারে সরস্বতী পূজার প্যান্ডেলে ক্লাসমেট ডাঃ অসিত চৌধুরী এবং এক বছরের জুনিয়র ডাঃ দিলীপ ব্যানার্জীর সাথে দেখা হয়েছিল । দিলীপ আমাদের ওর বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল । ওর বাড়ীতে দুদিন খুব হৈ - চৈ করে কেটেছিল । দিলীপ বলল যে গজেন বড়ো একটা কারুর সঙ্গে মেশেনা । যাই হোক ফোনে গজেনের সঙ্গে কথা বলবার পর প্রথমে খুব একটা আন্তরিকতার ছোঁয়া পেলাম না । কয়েক মিনিট কথা বলার পর ইংরাজীতেই ও নিজের থেকে আমাকে ওর বাড়ীতে ঘুরে যাবার জন্য অনুরোধ করল । ও তখন Homchurch বলে লন্ডনের একটা suburb- এ থাকত । লন্ডন থেকে ওখানে যেতে প্রায় এক ঘন্টা লাগত । Hornchurch- এ বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানী May & Baker এর বিরাট কারখানা ছিল । আমি ও আমার স্ত্রী মহুয়া হর্ণচার্চে পৌঁছলাম বেলা এগারোটা নাগাদ । মাঝারি গোছের স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একজন লোককেও দেখতে না পেয়ে আমরা হতাশ হয়ে গেলাম । স্ত্রীকে বললাম যে ফেরৎ ট্রেনে লন্ডন ফিরে যাই । মিনিট দুই অপেক্ষা করার পর দেখলাম যে একজন সুপুরুষ স্থানীয় সাহেব মনে হল আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। গজেনে বিশেষত্ব ছিল কলেজ জীবনে বেশ মোটা গোঁফ ছিল ও চুলের মাঝখানে সীতা/সিঁথি কাটত। কিন্তু কাছে আসতে মনে হোল যে তখনকার দিনের বিখ্যাত ইরানের সুদর্শন সম্রাট শাহ পেহেলভী । ঐ ভদ্রলোক একদৃষ্টে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে ইংরাজীতে ও পরে বাংলায় বললেন তুই প্রণব দত্ত না ? ও বলল যে প্রায় দুই দশক পরে ও বাংলাতে কথা বলল । আমার স্ত্রী আমাকে ফিসফিস করে বলল যে ভদ্রলোক যেন বহু যুগ পরে নিজের হারান ভাইকে খুঁজে পেয়েছে তাতে তার সব স্নেহ ও ভালোবাসা ঝরে পড়ছে । স্টেশন থেকে বেরিয়ে মিনিট দশের মধ্যে ওর বাড়ীতে পৌঁছলাম । গজেনের স্ত্রীর নাম খামানুসা ( ওকে খামু বলে ডাকত) উনি ইরানের তদানিন্তন বিখ্যাত বিদ্রোহী নেতা খোমেনির নিকট আত্মীয়া ছিলেন । আমাদের সবার জানা যে খোমেনির নেতৃত্বে ইরানের শাহ পেহেলভী ও তার পরিবারের সদস্যরা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ফ্রান্সে আত্মগোপন করেছিল । ওঁর নেতৃত্বে ইরানে তখন রাজার ক্ষমতা শেষ হয়ে গিয়েছিল । খামু এককালে খুবই সুন্দরী ছিল । কিন্তু কথাবার্তা একটু কম বলে । আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন আমি সিগারেট বা বিয়ার খাই কিনা । গজেন ওর বাড়ীতে পৌঁছাবার আগেই আমাকে অনুরোধ করেছিল যেন ওর স্ত্রীর সামনে আমি বলি যে এই রসে আমি বঞ্চিত । খাই না শুনে খামু বলল যে গজেনের দু - একজন বন্ধু আগে ওঁর বাড়ীতে অত্যাধিক মদ্যপানের ফলে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল । গজেন তখন হর্নচার্চে একটা ১০০ বেডের প্রাথমিক হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করত । ওর সঙ্গে হাসপাতাল ঘোরার সময় মনে হল যে গজেনের হাসপাতালের কর্মচারীদের মধ্যে ও খুবই জনপ্রিয় । হাসপাতাল থেকে ফিরে প্রায় তিন চার ঘন্টা ওদের সঙ্গে কাটালাম । ওঁদের দুটো মেয়ে কবিতা ও শ্যামা । ওরা দুজনেই বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল । গজেন ও খামু দুজনেই আমাদের আরো একটা দিন থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিল । ওদের অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি । কারণ এক সপ্তাহ পরে আমাদের দেশে ফিরে যাবার কথা । বছর দুই পর গজেন পুনাতে আমাদের সরকারী আবাসনে এসে একদিন কাটিয়ে গিয়েছিল । পরে ২৪-২৫ বছরে কদাচিত চিঠিপত্রের আদান প্রদান হয়েছিল । ১৯৯২ সালে একটা চিঠিতে ও লিখেছিল ও বাথরুমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল । তারপর আর কোন খবর পাইনি । লন্ডনে Bengal Medico বলে একটা সংস্থা আছে । ওখানকার সেক্রেটারি হলেন ডাঃ গৌতম ঘোষ ও এদেশে এলে আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে । গৌতম এবং বিলাতের অন্যান্য বন্ধুরা বলে যে গজেন কারুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না । স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই নাকি বার্ধক্য জনিত সমস্যায় ভুগছে। কলেজে পড়ার সময় আমরা বন্ধুরা চুটিয়ে আনন্দ করেছি । ষাট দশকের গোড়ায় কলকাতায় Doctor Series ইত্যাদি সিনেমাবলি দেখে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম । আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম যে আমাদের কলেজ জীবনে পেশাদরী এবং সামাজিক দিক থেকে অনেক বেশী আনন্দময় ছিল । আমাদের মধ্যে যে বন্ধুত্বের বন্ধন বা উষ্ণতা ছিল সেটা পরবর্তী জীবনে ততটা উপভোগ করিনি । পরিশেষে বলবো যে জীবন সায়াহ্নে এসে ঐ আনন্দমুখর দিনগুলির কথা আজ ৫০-৬০ বছর পরে মনে হয় যেন জন্ম জন্মান্তরে অপূর্ব , মলয় ও গজেনের মতো বন্ধুর দেখা পাই । আমি আজও সেই নস্টালজিয়াতে ভুগছি । স্মৃতি বেদনাঘন , বন্ধুত্ব আর সহযোগিতা বন্ধুত্বের হাতকে প্রসারিত করে আবার কখনো কখনো দূরত্বের ব্যবধানে হতাশ করে । দিন আসে দিন যায় কিন্তু পুরানো স্মৃতি , আনন্দ , বেদনা মনের মণিকোঠায় ঘুরে ফিরে আসে । তাই বলি বন্ধুর মত বন্ধু আজও দুর্লভ যা সতত সুখের অনন্দের স্মৃতিতে রোমাঞ্চ হয়ে উঠে বারবার ।

লেখক পরিচিতি -  

প্রণব কুমার দত্তর জন্ম কলকাতায় ১৯৩৬ সালে। পেশায় চিকিৎসক এবং পঞ্চাশ বছরের বেশী জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের (বা Public Health) বিশেষজ্ঞ। স্নাতকোত্তর প্রথম ডিগ্রী ১৯৬৬ সালে এবং পরবর্তীকালে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে পি.এইচ.ডি.। ত্রিশ বছরের বেশী আর্মিতে চাকরীর সুবাদে ভারতবর্ষের নানা জায়গা দেখার সুযোগ ঘটেছে। পুনায় আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে (AFMC)-এ পাঁচ বছর শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এন্ড ফ্যামেলি ওয়েলফেয়ারের (NIHFW) সঙ্গে শিক্ষকতা এবং স্বাস্থ্য গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওঁর লেখা দুটো বই ছাড়াও নব্বইটির বেশী বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা দেশে ও বিদেশের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বাংলা সংকলন কর্নেলের ডায়রী১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়।  ৬০-টি বেশী ভ্রমণ কাহিনী, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ নানা লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে।