জানা অজানা
ArchUtah ন্যাশানাল পার্কের-Delicate
গিরিখাত বা
ক্যানিয়ন
ড. তুষার রায়
নতুন দিল্লি
গভীর গিরিখাত বা ক্যানিয়ন যত গভীর, এর সম্বন্ধে আমাদের অনেকের জ্ঞান ততটা গভীর নাও হতে পারে,যদিও আমরা অনেক গিরিখাত দেখেছি এবং ভেবেছি যে ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে সেগুলো তৈরি হয়েছে। আসলে তা কিন্তু মোটেই না। গিরিখাত তৈরি হয় শক্ত জিনিষে নরম বস্তু কেটে নয়-অতি নরম বস্তুতে কঠিন পাথর কাটার ফলে। ঠিক তাই –লক্ষ লক্ষ বছর ধরে খরস্রোতা নদীর নরম জল বয়ে কেটেছে পাথর আর তার ফলেই তৈরি হয়েছে-গিরিখাত বা ক্যানিয়ন। তাই আজ এই গিরিখাত সম্বন্ধে কিছু জানার ইচ্ছে করছে। অনেকেই হয়তো আগে পড়েছেন বা দেখেছেন, তবে যারা পড়েননি বা দেখেননি,তাদের জন্যই আজ এই লেখা ।
গিরিখাতের কথা বললে যার কথা প্রথমেই মনে আসে আর ভ্রমণ-পিপাশুদের খুব প্রিয় আর পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ,তা হল আমেরিকার ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম পাড়ের প্রদেশ এরিজোনাতে অবস্থিত এই সুবিশাল গিরিখাত দৈর্ঘ্যে ৪৪৬ কিলোমিটার,চওড়া বা ব্যাপ্তি আর ১.৮কিলোমিটার গভীর। দূর থেকে দেখলে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মত লাগে। এই গিরিখাত পৃথিবীর সপ্তম (প্রাকৃতিক) আশ্চর্যে-র অন্যতম। বৈজ্ঞানিকদের মতে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ বছর আগে এর গঠন হয়েছিল,পাহাড় আর ঘন জঙ্গলের মাঝখানে। খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কলোরাডো (Colorado)মাটি-পাথর কেটে আপন রাস্তা বানিয়ে এই পথেই চলা শুরু করেছিল উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে। আর ওদিকে আমাদের “ওই নীলাভ গোলক”-এর ‘টেকটনিক’ কাজকর্মের মাধ্যমে এই মালভূমি / অধিত্যাকা-র দুইপাড় আরও উঁচু হয়ে উঠল। আমরা ‘ওই নীলাভ গোলকে’ জেনেছি যে আমাদের পায়ের নিচে অর্থাৎ পৃথিবীর ‘ম্যাণ্টেলে’-র নিচে প্লেট গুলি-যারা বছরে ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার সরে যাচ্ছে তাদের কাজের ফলে দুই পাড় আরও উঁচু হয়ে গেল। কথায় বলেনা,জল নিজের রাস্তা ঠিক বানিয়ে নেয়,কোন বাধা না মেনেই। এই ভাবেই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তৈরি হয়েছে ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরে খরস্রোতা কলোরাডো নদী ঘণ্টায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় গালফ অব মেক্সিকো হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে মিলিত হতে। এই তীব্র গতির কলোরাডো নদী মোটেই নাব্য নয়;তবুও কিছু দুঃসাহসী মানুষ এই নদীতে নৌকা চালিয়ে ‘অ্যাডভেঞ্চার’ উপভোগ করেন। জন ওয়েসলে পাওয়েল(John Wesley Powell )নামের এক দুঃসাহসী মানুষ তার ৯ জন সঙ্গীসহ প্রথম এই দুঃসাধ্য কাজ করেন। এই গিরিখাতের প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার কলোরাডোতে প্রথম কাঠের তৈরি নৌকা চালিয়ে ছিলেন। পাওয়েলই প্রথম ১৮৭১ সালে এর নামকরণ করেছিলেন,”গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন”। যারা “ম্যাকেনা’জ গোল্ড” নামের বিখ্যাত ছায়াছবিটি দেখেছেন তাঁদের কিছু আন্দাজ হবে কি ভয়ানক কাজ এই নদীতে নৌকা চালানো। আর উপর থেকে আদিবাসী তীরন্দাজদের আক্রমণ তো আছেই। এখনও কমসে কম ৫টি আদিবাসী জাতি এই ক্যানিয়নের গভীরে বাস করে। আগে অবশ্য অনেক আদিবাসী জাতিই এই ক্যানিয়নের গভীরে গুহায় বসবাস করতেন।এখন অবশ্য সরকার থেকে ওদের বিভিন্ন কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতির মূল স্রোতে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা করে সফলও হয়েছেন। প্রায় ৭০ জাতির স্তন্যপায়ী জন্তু,২৫০ জাতির পাখি,২৫ জাতির সরীসৃপ,আর ৫ জাতির উভচর প্রাণীর বাস এই ক্যানিয়নে। কাঠবিড়াল গুলো এত বড় যে ‘বেজি’ বলে ভুল হয়। এছাড়া জঙ্গলে আছে পুমা বা পাহাড়ি সিংহ।
পৃথিবীর আরও কয়েকটি নামকরা গিরিখাতের নাম দিলাম যদি সুযোগ পান ছাড়বেন না দেখে আসতে। এদের অন্তত একটিতে যাবার সৌভাগ্য লেখকের হয়েছে।সেটি হল সাউথ আফ্রিকার ‘ব্লাইড রিভার ক্যানিয়ন’।অবশ্য আমেরিকার ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ দেখার সৌভাগ্য দুবার হয়েছে।
এছাড়া পেরুর ‘কোলকা ক্যানিয়ন’,আমেরিকার হাওয়াই স্টেটে ওয়াইমিয়া (Waimea),ফ্রান্সের ‘ভার্দন গর্জ’ ,আইসল্যান্ডের Fjoarargljufur(faith-roar-gliu-vur) উচ্চারণটা আমাদের মুখে ঠিক আসবেনা, সাউথ আফ্রিকার ব্লাইড রিভার ক্যানিয়ন,নামিবিয়ার ‘ফিস রিভার ক্যানিয়ন’ আর ব্রাজিলের ‘ইতাইম্বেজিনহো ক্যানিয়ন’(Itaimbezinho) । কিন্তু এটা ভেবে বসবেন না যে এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গিরিখাত। সব চেয়ে বড় গিরিখাত আছে আসলে আমাদেরই বাড়ির খুব কাছে-তিব্বতে। তিব্বতের পাহাড়ি নদী ‘সাংপো’ যা পরে ভারতে নেমে এসে ব্রহ্মপুত্র নদ হয়েছে তারই দ্বারা তৈরি গিরিখাত ‘ইয়ারলুঙ সাংপো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ বা শুধু ‘সাংপো ক্যানিয়ন’ আমেরিকার ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ থেকে লম্বায় সামান্য বড়। এই ৫০৫ কিলোমিটার লম্বা আর ১৮০০০ ফুট গভীর সাংপো ক্যানিয়নই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গিরিখাত বলে মনে করা হয়। সবচেয়ে বড় গিরিখাতের কথাই যখন উঠল তখন বলতেই হয় মঙ্গলের গভীর গিরিখাত, ‘করোলেভ গিরিখাত’এর কথা। মঙ্গল গ্রহের উত্তর মেরুর কাছে অবস্থিত এই গিরিখাত গোলাকার আর ৮১.৪ কিলোমিটার এর ব্যস! বড় থালার মত এর কানা প্রায় ২ কিলোমিটার উঁচু আর এর গভীরতা? দু’ কিলোমিটার! এই গিরিখাতে এত বিশাল পরিমাণ বরফ জল আছে যা গললে ক্যানাডার বিশাল লেক ‘গ্রেট বিয়ার লেক’এর সমান জল হবে।এই গিরিখাতই সম্ভবত,আমাদের সূর্য মণ্ডলের সবচেয়ে বড় গিরিখাত।
লেখক পরিচিতি – দেয়াল পত্রিকা (হাতে লেখা) দিয়ে শুরু করেছিলেন স্কুলে
থাকতেই।পরে কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে শুকতারাতে লেখা প্রকাশিত হল- ‘অসীমের অন্বেষণ’। এরই মধ্যে ছোট-খাটো পত্র-পত্রিকায়
গল্প বেরুতে শুরু হলো।বিজ্ঞান বিষয়ক এবং ইতিহাসের পটভূমিকায় লেখা বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল জনপ্রিয় প্রবন্ধ।“দেশ”
ওয়েব সাইটেও প্রকাশিত হয়েছে জনপ্রিয় প্রবন্ধ। “দিল্লি থেকে”নামক দৈনিক ই-পত্রিকায় দুই মাসে তিনটি
ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে।পশ্চিম বঙ্গের অনেক ই-ম্যাগে প্রকাশিত আমন্ত্রিত বিশেষ
লেখা এবং ছোট গল্প বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছে।করোনা মহামারীর কারণে আর ও কয়েকটি লেখা
প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে কয়েক মাস ধরে । দিল্লি থেকে প্রকাশিত ই-ম্যাগাজিন,
“তাৎক্ষণিক”এ বিজ্ঞান ভিত্তিক সুখপাঠ্য এবং
জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কলম “জানা-অজানা” লিখছেন
বিগত ছ’মাস ধরে।এই ম্যাগাজিনেই প্রকাশিত অনেকগুলি ছোটগল্প
খুব জনপ্রিয় হয়েছে। তিনটি ছোটগল্প সংকলন হয়েছে এখন পর্যন্ত। দিল্লি থেকে প্রকাশিত
জনপ্রিয় “কলমের সাত রঙ”পত্রিকার লেখক
এবং একনিষ্ঠ ভাবে জড়িত।


