Advt

Advt

একটি কালো মেয়ের গল্প (পর্ব - ১) নিত্যরঞ্জন দেবনাথ, Ekti Kalo Meyer Galpo (Part - 1) by Nityaranjan Debnath, Tatkhanik Bangla/Bengali Free Web/Online Magazine


Photo by Vinit Vispute on Unsplash

 একটি

কালো মেয়ের

গল্প

পর্ব - ১

নিত্যরঞ্জন দেবনাথ,

চুঁচুড়া

 

 

__ বাবা, তোমাদের সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল।

 

__ কী কথারে মা, বল না কী বলবি।

 

_মা, তুমিও একটু শোনো, তোমাদের দুজনের কাছে কথাটা বলতে চাই।

 

- কিসের কথা রে?

 

-_ বলছিলাম, কাল তো রবিবার। আমার দু'জন বন্ধু আসবে। তোমাদের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চায়। |

 

_ তোর বন্ধু আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়? ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা । কোথাকার বন্ধু ? কী ব্যাপারে কথা বলতে চায়?

 

- আমার কলেজেরই লেকচারার । বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে। আমাকে বিয়ে করতে চায়। তাই তোমাদের সম্মতি চায়।

 

__ শুনে বাবা, মা দুজনেই আঁতকে ওঠেন। একি শুনছে তারা। হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে গেল। কারো মুখে কোন রুথা নেই। নির্বাক। মেয়ে বিয়ে করবে বলে নিজেই পাত্র ঠিক করে নিয়ে আসছে।

 

কথোপকথন চলছিল বাবা, মা এবং মেয়ের সঙ্গে। মেয়ের বিয়ের কথা শুনে তারা চিস্তিত। বৃদ্ধ পিতা-মাতা । কেমন অসহায় বোধ করছেন যেন। বিপদে-আপদে মেয়েই তাদের ভরসা। মেয়েই তাঁদের দেখাশোনা করে যে। এইতো গত এক বছরের মধ্যে দু'বার মা এবং একবার বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মেয়েই নার্সিংহোমে ভর্তি করালো, যত্ব-আন্তি করা, , ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা, পরামর্শ করা, খরচ-খরচা. মেটানো, সবই তো মেয়ে করল। কে আর করবে! ভদ্রলোকের কোন ছেলে নেই যে। মেয়েই ছেলের কাজ করে চলেছে। এখন যদি বিয়ে হয়ে যায়, মেয়ে পরের ঘরে চলে যায়, এরা যায় কোথায়। সেই ভেবেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চিত্তবৈকল্য।

 

মেয়ে কলেজের অধ্যাপিকা। বয়সও কম হয়নি। ত্রিশ পেরিয়ে একত্রিশে পাদিল। সত্যিই তো, বাবা, মায়ের উচিৎ সঠিক বয়সে মেয়েকে পাত্রস্থ করা। এতদিন তো বিয়ের কথা ভাবাই হয়নি। বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। . বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলেটি কেমন? বাড়ি কোথায়?”

 

মেয়ে বলল, “বাড়ি নর্থ বেঙ্গল-এ, শিলিগুড়ি। এখন আমাদের কলেজের কাছেই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। এমনিতে তো ভালোই মনে হয়।

 

মেয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো, “হ্যাঁ, পছন্দ ।

 

মা এতক্ষন নীরব ছিলেন। কোন কথা বলেন নি। তবে তিনি যেন চাইছেন না মেয়ের বিয়ে হোক।

 

মা বললেন, “তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি? এমন কথা ভাবতে পারলি?”

 

মেয়ে বলল, তোমরা যদি না চাও, করব না বিয়ে ।

 

বাবা, মাকে বললেন, “তুমি অমন স্বার্থপরের মত কথা বলছ কেন? ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে হবে না? আরো আগেই আমাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ ছিল।

 

মা বললেন, “তা যখন হয়নি, আর ওপথে যাস না মা। আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাস না। তুই তো আমাদের মেয়ে হলেও ছেলের কাজ করছিস। তুই ছাড়া আমাদের কে আছে বল?” দায়িত্ব খরচখরচা সব আমিই দেব। সে রকমই কথা হয়েছে”.

 

বাবা বললেন, “সে পরে দেখা যাবে। তুই ছেলেটিকে আসতে বল।

 

মেয়ে ভাবছে অন্য কথা। অতীত দিনের কিছু কথা। মা কি মনেপ্রাণে চান না মেয়ে বিয়ে করে সংসার করুক।  

 

(২)

 

মেয়েটি কালো। গায়ের রঙ ময়লা । একমাত্র কালোর জন্যই বাড়িতে কদর কম। .তিন বোন ওরা। তিন বোনের মধ্যে বড় এবং ছোটটি বেশ ফুটফুটে, সুন্দরী হয়েছে। মাঝখান থেকে মেজটি কেন যে কালো হলো, ভাবা যায় না। মানুষ সুন্দরের পুজারি। সুন্দরকে সবাই ভালোবাসে, কাছে পেতে চায়, দুদন্ড বসে গল্প করতেও ভালো লাগে। সে আপন হোক বা পর, সবার সুন্দরের দিকেই নজর। তারই কদর বেশি। অন্যদিকে কালো প্রতি নজর নেই। সে তার নিজের বাবা, মা হলেও সমান দৃষ্টিতে দেখেন না। এটাই দুর্ভাগ্য। শুধু কি তাই। তাকে যে কতরকম কষ্ট সহ্য করতে হয়, কহতব্য নয়। এমনই একটি পরিবারের কর্তা শ্রী চন্দন দত্ত ও তার স্ত্রী অনিমা দত্তের তিন মেয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবার। নির্ঝঞ্ঝাট  সুখের সংসার বলা চলে। তনিমা, নীলিমা এবং চন্দ্রিমা তিন বোন পিঠোপিঠি বড় হচ্ছে। বয়সের ফারাক বেশি নয়। সবাই দেড়, দু বছরের ছোট, বড়। ওরা নিজেদের মধ্যে খেলাধূলা, হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেই পড়াশুনা করতে করতে বড় হচ্ছে। এদের মধ্যে মিলমিশ খুব। এক বোন আরেক বোনকে ছাড়া থাকতে পারে না। সবাই সবার খেলার সাথি। খুনসুটি, ঝগড়াঝাটি যে হয় না, তা নয়, হয়। হলেও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এ যে বললাম, একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারে না। প্রত্যেকেই বাবা, মায়ের খুব আদরের। খুব ভালোবাসেন তারা। ফলে মাঝেমধ্যে অবাঞ্ছিত আবদারও মেটাতে হয় তাদের। এমনিভাবেই বড় হচ্ছিল তারা। প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যখন ওরা হাইস্কুলে পড়তে শুরু করে, তখন থেকেই একটু অন্য ধারায় চলতে লাগলো যেন। এক জনের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব। এ যে মেজ মেয়েটি __ যার নাম নীলিমা, সেই তো কালো। মায়ের এক কথা-কালো মেয়ের বেশি পড়াশুনো করার দরকার নেই। পাত্র পাওয়া . যাবে না। শিক্ষিত ছেলেরা নাকি কালো মেয়ে বিয়ে করতে চায় না। আবার অশিক্ষিত ছেলেরাও অমন ঢ্যাঙা বিদ্যাধরীকে বিয়ে করতে চাইবে না। অর্থাৎ তার আর পড়াশুনা করে কাজ নেই। মায়ের এমন অকাট যুক্তি মস্তিষ্কে গেঁথে আছে, তা সরানো মুশকিল। কারো কথাই শুনবেন না তিনি।  অথচ তিনবোনের মধ্যে নীলিমারই অপেক্ষাকৃত মেধা বেশি। পড়াশুনায় ভালো। স্কুলে প্রতি বছর ফার্স্ট হয়। তাকেই তিনি পড়াতে চান না। যে ' কোন ছুতোয় মাঝেমধ্যে তার স্কুল যাওয়া বন্ধ । মাঝে মধ্যেই মা বলেন --আমার শরীরটা ভালো নেই। রান্নাটা তোকেই করতে হবে । আজ স্কুলে যেতে হবেনা ।

 

-   সে আমি রান্নাবান্না করেই স্কুলে যাব মা। তোমার কোন চিন্তা নেই।

 

-   না, তোকে আজ যেতে হবে না বলছি, যাওয়া হবে না, ব্যাস।

 

এইভাবে অহরহ তার স্কুল কামাই হতে থাকল। সপ্তাহে অন্তত দুদিন তার ইস্কুলে যাওয়া হত না। এতে মেয়েটি আরো জেদি হতে থাকল। বাড়ির রান্নাবান্না এবং বাড়ির ঘরোয়া সব কাজ নিজে একাই করেও বইপত্র নিয়ে বসে পড়ত। স্কুলে না গেলেও স্কুলের পড়াটা তার করে রাখা চাই। না বুঝতে পারলে পরদিন স্কুলে গিয়ে শিক্ষিকাদের কাছ থেকে শিখে নিত। সেদিক থেকে তার কোন সংকোচ ছিল না। যেহেতু মেয়েটি প্রতিবছর  ফার্স্ট হয়, দিদিমনিরাও খুব সহযোগিতা করতেন।

 

এতে মেয়েটির দুটো কাজ হয়, এক-বেশ পরিশ্রমী হয় এবং সংসারের , রান্নাবান্না এবং  গৃহকর্মে নিপুনা হয়ে ওঠে। এছাড়া সহ্যশক্তিও বেড়ে যায়। তবু মন বলে তো একটা বস্তু আছে। তাকে দমন করা কষ্টকর। কেউ আঘাত দিয়ে কথা বললে বা অবহেলা করলে বুকের ভিতর তার আলোড়ন হবেই।

 

আর সে যদি তার একান্ত নিজের লোক হয় - কষ্টটা আরো বেশি হয়। সহজে ভোলা যায় না, সারাক্ষণ মনের গভীরে কাঁটার মত খচখচ করে। সারাজীবনই তা মনে থাকে। এমনই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। নীলিমা ক্লাস এইট থেকে নাইন এবং চন্দ্রিমা নাইন থেকে টেন হল। তিন বোনই মার্কশিট নিয়ে হৈ,হৈ করতে করতে বাড়ি ফিরল। সবাই ভালোভাবে পাশ করেছে। তবু নীলিমার রেজাল্ট দুর্দাস্ত ভালো । ক্লাসের মধ্যে শুধু প্রথম য়েছে তাই নয়, কয়েকটা সাবজেক্টে একশোর মধ্যে একশোই পেয়েছে।  অন্য দু বোনের কিন্তু প্রথম দশজনের মধ্যেও স্থান নেই। অথচ মা এ দু বোনের পাশের খবরেই উচ্ছাসে ফেটে পড়ছেন। কত আনন্দ। বাবা অবশ্য তিনজনেরই প্রশংসা করছেন। মা নীলিমার কথাটা মুখেই আনছেন না। এতে কালো মেয়েটার দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক । তাই নীলিমা বাধ্য হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “মা তুমি কি আমার রেজাল্টে খুশি হওনি ?” মা উত্তর দিয়েছিলেন, আজও স্পষ্ট মনে আছে।

 

মা বলেছিলেন, “তোর রেজাল্টে খুশি অখুশির কি আছে তোর তো জীবনে বিয়েই হবে না। তুই ঘরও পাবি না, বরও পাবি না। তোকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার কি আছে। আমার তনু, ন্দ্রাকে দেখ, দেখতে যেমন সুন্দরী, ওদের ভাগ্যও তেমন সুন্দর, দেখবি ওদের কেমন রাজপুত্তুরের সঙ্গে বিয়ে হয়। তোর মত পোড়া কপাল নিয়ে জন্মায়নি ওরা ।”        (চলবে) ...  আগামীকাল সমাপ্ত ।

লেখক পরিচিতি: 

জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন। তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট,  দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর  ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন। তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।