Advt

Advt

বিবেকানন্দের সাহিত্যচেতনা ও সাহিত্যকৃতি - বাসুদেব রায় Tatkhanik Bangla / Bengali Free Web / Online Magazine

 


বিবেকানন্দের সাহিত্যচেতনা

ও সাহিত্যকৃতি

বাসুদেব রায়, ইসলামপুর

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর প্রধানতম সন্ন্যাসী শিষ্য স্বামীবিবেকানন্দ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণমঠ ও মিশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা, এটাই স্বামীজির স্বাভাবিক পরিচয়। কিন্তু তার গুরুপ্রেমতথা ঈশ্বরপ্রেমের পাশাপাশি মাতৃ-পিতৃপ্রেম, জীবপ্রেম, দেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম ইত্যাদির সঙ্গে সাহিত্যপ্রেমও উল্লেখযোগ্য। বিবেকানন্দের সাহিত্যচেতনা ও সাহিত্যকৃতিও উপেক্ষণীয় নয়। বিশ্বজয়ী বীরসন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে একজন মহান কর্মযোগী ও মুক্ত চিন্তানায়ক হিসেবে সাধারণত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। কিন্তু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিবেকানন্দের অন্যান্য দিকগুলো জনসমক্ষে তেমনভাবে আলোচিত হয়না। স্বামীজি একাধারে ছিলেন সংগঠক, সাধক, যোগী, সন্ন্যাসী, ধর্মতত্ত্ববেত্তা, বেদান্তিক, তার্কিক, দার্শনিক, বাগ্মী, সঙ্গীতজ্ঞ,সঙ্গীত শিল্পী, লেখক, সাহিত্যমনস্ক, ভোজন রসিক, কুস্তিগীর, ফুটবল খেলোয়াড় ইত্যাদি। আমাদের আলোচ্য বিষয় স্বামী বিবেকানন্দের সাহিত্যচেতনা ও সাহিত্যকৃতি। সেজন্য তার সুবিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্য থেকে আলোচ্য বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গের মধ্যে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার সিমলা পল্লীর দত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন সেকালের বিখ্যাত অ্যাটর্নি। ইংরেজি,বাংলা, ফারসি (পারসি), সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা জানা এই ব্যক্তিত্ব আইন বিষয়ক বইপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের (সাহিত্য, সঙ্গীত, জ্যোতিষ, জ্যোতির্বিদ্যা, রন্ধনবিদ্যা ইত্যাদি) বইও পড়তেন। সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে তিনি লেখালেখিও করতেন। হিন্দুপূজাপদ্ধতি নিয়ে বই লেখার পাশাপাশি বিশ্বনাথ দত্ত সুলোচনানামক উপন্যাস ইত্যাদি লিখেছেন। সাহিত্যচেতনা তথা সাহিত্য-সঙ্গীতাদির প্রতি অনুরাগ নরেন্দ্রনাথ তথা বিবেকানন্দ ছোটবেলা থেকেই পিতার কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন সেটা বলা যায়। মধ্যযুগ থেকে বাংলা সাহিত্যকে আধুনিক যুগে উন্নীত করতে তথা বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের সামর্থক প্রতিষ্ঠায় বাংলা সাময়িক পত্রের অবদান অনস্বীকার্য। ১৭৮০ সাল থেকে যাত্রা শুরু করা বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে স্বামী বিবেকানন্দের নাম অক্ষয় হয়ে রয়েছে। ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে বিবেকানন্দ উদ্বোধননামক একটি সাময়িক পত্রপ্রকাশ করেন। প্রথম দিকে কয়েকটি সংখ্যা পাক্ষিক হিসেবে বেরুলেও পরবর্তীকালে উদ্বোধন মাসিক পত্রিকা হিসেবেই স্থায়িত্ব লাভ করে। উক্ত সাময়িক পত্রটি অদ্যাবধি(২০১২) নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে একটানা এত দীর্ঘকাল কোন সাময়িক পত্রের টিকে থাকার নজির নেই বললেই চলে। ধর্ম,দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ক লেখা সমৃদ্ধ উদ্বোধননামক সাময়িক পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন স্বামী বিবেকানন্দের সুপরিকল্পিত নির্দেশে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ভাবনা এবং তাঁর অনুসারীদের ত্যাগ, নিষ্ঠা, অমানুষিক পরিশ্রম ইত্যাদিই উদ্বোধন’-কে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, পাশাপাশি সুদীর্ঘ আয়ু দান করেছে। উদ্বোধনরামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এবং সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণভাবপ্রচারের দিকটাই প্রধান। কিন্তু এটির মাধ্যমেই স্বামী বিবেকানন্দ নতুন ভাষা, নতুনভাব ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিবেকানন্দের ভাষায় – “ঠাকুরের ভাবতো সব্বাইকে দিতে হবেই; অধিকন্তু বাঙলা ভাষায় নুতন ওজস্বিতা আনতে হবে। এই যেমন ঘন ঘন Verb (ক্রিয়াপদ)-এর ব্যবহার করলে, ভাষার দম কমে যায়। বিশেষণদিয়ে Verb-এর ব্যবহারগুলি কমিয়ে দিতে হবে।তিনি আরও বলেছেন উদ্বোধনে সাধারণকে কেবল পজিটিভ আইডিয়া অর্থাৎ গঠনমূলক ভাব  দিতে হবে। নেগেটিভ থট অর্থাৎ নেতিবাচক ভাব মানুষকে দুর্বল করে দেয়। ..ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, কবিতা,শিল্প সকল বিষয়ে যা চিন্তা ও চেষ্টা মানুষ করেছে, তাতে ভুল না দেখিয়ে ওই সব বিষয়ে কেমন করে ক্রমে ক্রমে আরও ভাল রকমে করতে পারবে, তাই বলে দিতে হবে।গবেষকদের ধারণা - স্বামী বিবেকানন্দ ভাষা বিজ্ঞানী হলে তার ধারেকাছে ঘেষতে পারতেন না কেউ। ভাষা বিজ্ঞান নিয়ে সীমিত পরিসরে তিনি যেটুকু চর্চা করেছেন তাই-বা কম কিসে? তিনি বিশ্বাস করতেন,ভাষা ভাবের বাহক। ভাবই প্রধান, ভাষা পরে। হীরে-মতির সাজ-পরানো ঘোড়ার ওপর বাঁদর বসালে কি ভাল দেখায়? বাংলা ভাষায় কেমন করে আম বাঙালির বোধ্য গদ্য লেখা যায়, তা নিয়ে স্বামীজি গভীরভাবে চিন্তা করতেন। ওস্তাদি গানের ওপর যেমন তিনি বিরক্ত ছিলেন, তেমনি পণ্ডিতিসন্ধি-সমাস বহুল গদ্য তিনি পছন্দ করতেন না। অবশ্য, তিনি সাধু ও চলিত দুই ভাষাতেই লিখতেন। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামী বিবেকানন্দ যখন দেহত্যাগ করেন তখন তার বয়সচল্লিশ বছরও পূর্ণ হয়নি। এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের পার্থিব জীবনে স্বামীজি বাংলা ভাষায় খুব বেশি মৌলিক রচনা করতে পারেননি। বাংলায় লেখা চিঠিপত্র, কিছু কবিতা আর হার্বার্টস্পেনসারের শিক্ষা বিষয়ক রচনার বাংলা অনুবাদ বাদ দিলে তার নামে প্রচলিত বাংলা বই চারটি – ‘ভাববার কথা’, ‘বর্তমান ভারত’, ‘পরিব্রাজকএবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। অবশ্য, স্বামীজি তার বেশির ভাগ লেখাই ইংরেজিতে লিখেছেন। তার লেখা অসংখ্য চিঠি, বিভিন্ন সভায় প্রদত্ত ভাষণ, বিচিত্র বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ, এমনকি অনেক কবিতাও লিখেছেন ইংরেজিতে। স্বামী বিবেকানন্দের ইংরেজি গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - 'Karmayoga', 'Rajayoga', 'Jnanayoga', 'Bhaktiyoga' ইত্যাদি। স্বামীজি সংস্কৃত ভাষাতেও যথেষ্ট দক্ষ ও সুপণ্ডিত ছিলেন। সুযোগ পেলেই তিনি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্য ও ব্যাকরণ কৌমুদীর সুত্রগুলো নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করতেন। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে,সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে বিবেকানন্দের অসামান্য পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও তিনি সচেতন ভাবে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত প্রভাব থেকে মুক্ত করে চলিত বাংলার প্রাণপ্রতিষ্ঠার জন্যে সারা জীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। স্মর্তব্য, স্বামীজি যখন ঝকঝকে চলিত গদ্য লিখছেন তখনও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) পর্যন্ত সাধু গদ্য ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দ্বিধাগ্রস্ত, সমসাময়িক অন্যদেরতো কথাই নেই। অবশ্য,পরবর্তী কালে প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্যাপক ভাবে চলিত ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন সেটা ভিন্ন কথা। সাহিত্য বিলাসের জন্যে নয়, বরং সামাজিক চেতনাকে জাগিয়ে তোলার অভিপ্রায়েই বিবেকানন্দ সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মানবতার সেবা ছিল তার সামগ্রিক লক্ষ্য। প্রবাদবাক্যের মত রূপ নেওয়া তার সুবিখ্যাত কবিতা তথা বাণী বহুরূপেসম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথায় খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জনসেবিছে ঈশ্বর।” “শিব জ্ঞানে জীব সেবা করার মহান ব্রতের অনুষঙ্গ হিসেবে স্বামীজি লেখায় মনোনিবেশ করেছিলেন। লেখা তার পেশা বা নেশা ছিল না। তা সত্ত্বেও স্বামীবিবেকানন্দের সাহিত্যচেতনা ও সাহিত্যকৃতি যথেষ্ট প্রশংসনীয়। পরিশেষে, জন্মদিনে বিশ্ববিজয়ী বীরসন্ন্যাসী মানবতার পূজারী স্বামীজিকে আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানয়ে ইতি টানছি।

লেখক পরিচিতি 

ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ)দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থএকাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।

ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপমধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন।