যদিদং হৃদয়ং
(রম্য রচনা)
ভীষ্মলোচন শর্মা,কলকাতা
আজ আমি আপনাদের বিবাহের পরবর্তী গোলমেলে বিষয় নিয়ে গল্প বলব। তবে গোলমেলে
গল্পে যাবার আগে এক শ্রদ্ধেয় লেখকের বিবাহ সম্পর্কে একটি মন্তব্য স্মরণ করে নিই।
‘বিবাহ হল বুফে সিস্টেমের খাওয়ার মতো। খাবার টেবিলে বসে পাশের লোকের প্লেটের
খাবারের দিকে তাকিয়ে মনে হয় ওর খাবারটা বোধহয় আমার চেয়ে ভালো। কিন্তু তখন আর
খাবার পরিবর্তন করার উপায় থাকে না। কারণ, এক পেট প্রায় ভরে গেছে আর দুই, খেতে বসে খাবার পরিবর্তন করাটা মোটেই
ভব্যতা নয়। তাছাড়া পাশের লোকটি হয়তো ঠিক সেই একই কথাই ভাবছে।
তাই ‘যদিদং হৃদয়ং’ বলে যাঁকে ঘরে
এনেছেন তাঁর সঙ্গে ‘জীবন কাটানোই’ বুদ্ধিমানের কাজ। যতই তাঁর হাতে চড়-থাপ্পড় খেতে
হোক।
স্বামীর হাতে স্ত্রী নিগৃহীত হলে
আইন তার ব্যবস্থা নেবার জন্য তৎপর। কিন্তু স্ত্রী’র হাতে স্বামীর নিগৃহীত হবার
ঘটনা যে ক্রমশ বাড়ছে সে ব্যাপারে কোনো খবর রাখেন কি? কিছুদিন আগে আমি আপনাদের স্বামীত্ব ক্লেশ নিবারণ সমিতির কথা
বলেছিলাম। তা পড়ে এক পাঠক লিখেছেন, আপনি মশাই বড্ড গুলতাপ্পি মারেন। এরকম সংস্থা
আছে নাকি?
আলবাৎ আছে। যুগে যুগে সারা পৃথিবীতে
স্ত্রীদের হাতে স্বামীরা নিগৃহীত হয়েছেন। তাই যুগে যুগে তাঁরা এই নিপীড়নের হাত
থেকে পরিত্রাণের জন্য সংঘ গড়েছেন, আন্দোলন করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। আজ আমি আপনাদের
সেই আন্দোলনের গল্প বলব। যে গল্প দাম্পত্য জীবনের করুণ ইতিহাসের গল্প, যে গল্প
শহীদ স্বামীর গল্প, যে গল্প স্ত্রী’র অত্যাচারের অকথিত গল্প। বলা বাহুল্য, গল্পগুলি
আমার নয়, ধার করা।
এক পাঠক লিখেছেন, ভীষ্মলোচনের
লেখায় ‘বড়ো বিদ্যা’র বড়ো প্রভাব। অভিযোগ স্বীকার করে তাঁর উদ্দেশ্যে আলঙ্কারিক
হেমচন্দ্রের কথাটা বলব। কাব্যানুশাসনের টিকা লিখতে গিয়ে হেমচন্দ্র বলেছেন, ‘নাস্ত্য
চৌর লেখকজন, নাস্ত্য চৌর বণিকজন’ অর্থাৎ ‘বড়োবিদ্যা’টি স্যাকরা এবং লেখকমাত্রেরই
বিলক্ষণ রপ্ত আছে।
তাছাড়া মহাকবি হাইনরিখ হাইনে
বলেছেন, যাঁরা লেখকের লেখায় নির্ভেজাল অরিজিন্যালিটি চান তাঁরা মাকড়সার জাল
চিবোতে পারেন। কারণ, মাকড়সাই তার জালটি তৈরি করে আপন পেটের মাল দিয়ে। ষোল
আনা অরিজিন্যাল। কিন্তু মধুভান্ডের
প্রতিটি ফোঁটা ফুলের কাছ থেকে চোরাই করা।
আমিও তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাই
করা মাল এনে আপনাদের সাপ্লাই করি। চোরাই মালের স্বাদ আলাদা।
গল্পটা বিদেশি। স্ত্রী’র অত্যাচারে
লন্ডনের স্বামীরা একবার সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামলেন। স্ত্রীদের নিপীড়ন প্রতিহত
করার জন্য অত্যাচারিত স্বামীদের আড়াই মাইল লম্বা এক মিছিল বেরোলো লন্ডনের
রাজপথে। মিছিলের একেবারে সামনে পাঁচফুট লম্বা টিঙটিঙে এক ভদ্রলোক। তিনিই নেতৃত্ব
দিচ্ছেন মিছিলের। তড়পাচ্ছেনও বেশি। স্লোগানে ভরিয়ে দিচ্ছেন লন্ডনের আকাশ।
(নিন্দুকে বলে স্ত্রী’র হাতে মার খেয়ে ভদ্রলোকের চেহারা হয়েছে অমন হাড্ডিসার।)
তো ঠিক সেই মুহূর্তে এই মিছিলের প্রতিবাদে রাস্তার অপর দিক থেকে আসছিল সাড়ে তিন
মাইল লম্বা স্ত্রীদের এক মিছিল। সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন জাঁদরেল চেহারার এক
ভদ্রমহিলা। হাতে তাঁর একটা বিপুলাকায় ঝাঁটা। ঝাঁটাটা তিনি মাঝে মাঝে শূন্যে তুলে
ঘোরাচ্ছেন।
মিছিল দুটো ঠিক মুখোমুখি হতে হঠাৎ করে নেত্রী সেই জাঁদরেল
চেহারার ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে ঝাঁটা ফেলে টিঙটিঙে ভদ্রলোককে ঘাড় ধরে এক ঝটকায় তুলে
ফেললেন শূন্যে। ভদ্রলোক কোনো কিছু বোঝার আগেই দেখলেন তিনি শূন্যে দোদুল্যমান।
চিংড়ি মাছের মতো বিস্তর লাফালাফি করেও তিনি কোনো সুবিধা করতে পারলেন না।
ভদ্রমহিলা গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আমি কি তোমার ওপর অত্যাচার করি যে তুমি এ মিছিলে
এসেছ। যাও বাড়ি যাও।’
এবার একটা চিনের গল্প। গল্পটা মুজতবা আলি সাহেবের। একদা চীন
দেশের পেপিং শহরে অত্যাচারিত স্বামীরা এক মহতী সভার আয়োজন করেন। সভার উদ্দেশ্য,
কী প্রকারে স্বামীকূল তাঁদের খান্ডার গৃহিণীদের হাত থেকে রক্ষা পান। সভাপতির আসনে
বসানো হল সবচেয়ে অত্যাচারিত বৃদ্ধ এক অধ্যাপককে। যিনি অর্ধশতাব্দী ধরে গৃহিণীর
হাতে অশেষ অত্যাচারে ভুগছেন এবং সেই অত্যাচারের কথা শহরশুদ্ধ ছেলেবুড়ো সবার জানা।
সভায় একের পর এক বক্তা গম্ভীর কন্ঠে স্ত্রীদের অত্যাচারের
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে যাচ্ছেন। স্ত্রী’র অত্যচারে দেশ গেল, ধর্ম গেল,
ঐতিহ্য গেল। চীন দেশ ক্রমশ হটেনটটের মুলুকে পরিণত হতে চলল।
এ অত্যাচার যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে।
এমন সময় এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, মহাশয়রা,
আপনাদের গিন্নিরা কী করে এ সভার খবর টের পেয়ে ঝাঁটা, জুতো, ভাঙা ছাতা নিয়ে এদিকে
ছুটে আসছেন।
যেই না শোনা, আর যায় কোথায়। সভার উদ্যোক্তা সহ শ্রোতারা
সব দে ছুট, দে ছুট। সাড়ে তিন সেকেন্ডের মধ্যে মিটিং সাফ। সব বিলকুল ফাঁকা।
কেবলমাত্র সেই অত্যাচার জর্জরিত বৃদ্ধ সভাপতি বসে আছেন,
শান্ত গম্ভীর মুখে। তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। দু-একজন উদ্যোক্তা তা দেখে
বললেন, স্যার, আপনি শিগগির পালিয়ে যান। এখানে
বসে থাকা আত্মহত্যার সামিল। যাঁরা ছুটে আসছেন তার পয়লা নম্বরেই আছেন আপনার
স্ত্রী। চলুন, আমরা আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। সভাপতি তবু চুপ।
উদ্যোক্তারা তাঁকে জোর করে টেনে তুলতে দেখেন সব ঠান্ডা। ভয়ে তিনি হার্ট ফেল
করেছেন।
গল্পটা বড়ো মর্মান্তিক হয়ে গেল। এবার তাই একটা অন্য গল্প
বলি। গল্পটা ভারতীয়। অনেক অনেকদিন আগে
একবার এক রাজার ইচ্ছা হল তাঁর রাজ্যে স্ত্রীকে ভয় করে চলেন এমন পুরুষের
সংখ্যা কত তা জানতে। তিনি মন্ত্রীকে বললেন, ব্যবস্থা কর। মন্ত্রী রাজ্যজুড়ে
ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন, ‘রাজার আদেশক্রমে আগামীকাল সকাল দশটায় রাজ্যের সব বিবাহিত
পুরুষকে কেল্লার মাঠে আসতে জানানো যাইতেছে। নইলে গর্দান যাবে।’
রাজার আদেশ। ফলে পরদিন সকালে কেল্লার মাঠে লোকে লোকারণ্য।
রাজা আর মন্ত্রী গিয়ে বসলেন কেল্লার ছাদে। মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ‘সমবেত
ভদ্রমন্ডলী, আপনাদের মধ্যে যাঁরা স্ত্রীকে ভয় করে
চলেন তাঁরা কেল্লার ডানদিকে যান। আর যাঁরা ভয় করেন না, তাঁরা বাঁ-দিকে।
খানিকক্ষণ পর দেখা গেল সব ভিড়টাই গিয়ে জুটেছে কেল্লার
ডানদিকে। আর বাঁদিকে শুধু একজন দাঁড়িয়ে ইতি-উতি দেখছে। রাজা বললেন, ‘দেখো
মন্ত্রী, এত বড় দেশে এই একটিমাত্র লোক যিনি স্ত্রীকে ভয় করেন না।’ মন্ত্রী বললেন,
‘দাঁড়ান রাজামশাই, আগে বিষয়টা দেখি।’ তিনি লোকটাকে ডাক করালেন, লোকটা এল।
তিনি বললেন, ‘তুমি কি তোমার স্ত্রীকে ভয় করো না?’
-করি তো। লোকটার সরল স্বীকারোক্তি।
-তবে ডান দিকে না গিয়ে বাঁদিকে গেলে কেন?
বেরোনোর আগে বউ বলে দিয়েছে, ‘ভেড়ার পাল যেদিকে যাবে, তুমি
সেদিকে যাবে না, মনে থাকে যেন। তা হলে কিন্তু আস্ত রাখব না।’