
চন্দ্রার
স্বপ্ন
-সুব্রত ঘোষ, নতুন দিল্লি
বিকেল পাঁচটায়
বেরিয়ে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই দুটো
বাড়ির রান্নার কাজ শেষ করে অটো নিয়ে মসজিদ বাড়ি লেনের একাত্তর নম্বর বাড়ির সামনে নামে
চন্দ্রা ।লোকের বাড়িতে রান্না করলেও চন্দ্রা সব সময় সুসজ্জিতা ফিটফাট থাকতে পছন্দ করে । দেখতে খারাপ নয়, আলগা চটক আছে
। তাই একটু ব্রাইট কালারের শাড়িতে কেমন একটা গুডি গুডি ভাব এসে
যায় ।সম্প্রতি একটা টাচ ফোন কিনেছে ।সোশ্যাল মিডিয়া আর অ্যাপের কল্যাণে বাইরের
জগতের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বেড়ে গেছে,
যেমন এই মসজিদ বাড়ি লেনের একাত্তর নম্বর বাড়ির কথা। প্রতি বুধবার আর শনিবার সন্ধ্যায়
বাড়ির মালিক যিনি আর বছরের দুইয়ের মধ্যেই আশির হার্ডল পার করবেন , খুব ক্লোজ সারকেলের
একান্ত জানাশোনা লোককে নিয়ে একটু আনন্দ স্ফূর্তি করেন । ষাঠোর্দ্ধ এইসব বন্ধুদের নিয়ে একটু গল্প গুজব আর তাস খেলার সঙ্গে থাকে অল্প স্বল্প মদিরা ও হাল্কা করে মারিজুয়ানা
সেবন । সেটা অবশ্য বৃদ্ধাবস্থায় ডাইজেস্টিভ সিস্টেমকে বাগে রাখার তাগিদে । শরীরকে ফিট
রাখার জন্য । এতো বড় বাড়িতে সব সময়ের কাজের লোক নিয়ে একা থাকা ।স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক
দিন ।তাঁর মুখটাও এখন ঠিক মতো মনে পড়ে না । শেষ বয়সে ইজ্জতে আঁচ না লাগে সেদিকে খেয়াল রেখে
চন্দ্রার মতো অল্পবয়সী ভদ্রমহিলাদের
সান্নিধ্যে আনন্দ বা স্ফূর্তি করাটাই শ্রেয়
বিবেচনা করেন । চন্দ্রা অবশ্য নিজে ওসব ছোঁয়
না। কেবল বয়স্ক মানুষগুলোর সামনে গ্লাস, বরফ ইত্যাদি এগিয়ে দেওয়া আর হাসিমুখে চোখ
নাচিয়ে মাঝে মধ্যে ওঁদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে ওদের আনন্দটাকে একটু বাড়িয়ে
দিয়ে মডার্ন শাকী সেজে থাকা ঘণ্টা দেড়-দুই মতো । ব্যস ,তাতেই এঁরা খুশি
। এঁদের দেখে চন্দ্রার শৌকীন সিনেমাটার কথা মনে পড়ে ।চন্দ্রা জানে এদের
ভয় পাবার তেমন কোনও কারণ নেই। তাই এদের সাহচর্য
দিতে চন্দ্রার কোনও আপত্তি থাকে না ।ওর মনেও কোনও দুঃখ নেই ।বরং ওকে মেয়ে জন্ম দিয়ে
পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য ও ভগবানকে ধন্যবাদ দেয়।

সাত বছর আগে ফার্স্ট
ইয়ারে পড়ার সময় পাড়ার ইলেক্ট্রিক্যাল গুডস্ এর দোকানের সুজয়ের কোঁকড়ানো চুল আর দুটো ঝকঝকে চোখে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে নিজের
ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে সুজয়ের নিজস্ব ইলেকট্রিক এর দোকানের বাসনাকে নিজের বাসনা করে
নিয়ে বাড়ির অমতে সুজয়কে ভালোবেসে বিয়ে করে
ফেললো । তারপর বছর না ঘুরতেই তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হিসেবে কোলে এলো চয়ন, যে গত পরশু পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পড়েছে । চয়নের জন্মের
দেড় বছর পর এক দুর্যোগের রাতে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় গাড়ির ধাক্কায় সুজয়ের বাঁদিকের
চোয়াল আর চোখের সঙ্গে বাঁ হাত এবং বাঁ পা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ।বেশ কিছুদিন হাসপাতালে
কাটিয়ে ভাগ্যের জোরে বাড়ি ফিরে ছিল বটে ,তবে
সেটা শুধুই অকর্মণ্য প্রতিবন্ধী হয়ে বাড়িতে বসে থাকার জন্য ।যে চোখের ভুলভুলাইয়ায় আটকে,
যার হাসি-হাসি মুখের মনমাতানো কথায় সম্মোহিত হয়ে চন্দ্রা নিজের বাড়ি ছেড়ে ওর হাত ধরে
বেরিয়ে এসেছিলো, তা এখন চন্দ্রার কাছে কেমন যেন অবাস্তব বলেই মনে হয়।কেবল মাত্র ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই চন্দ্রা নিজের সব দুঃখ ভুলে যায়।কারণ ওই এক্সিডেন্টের পর সুজয়ের কাজে যাওয়া বন্ধ হয়ে
গিয়ে দিনে দিনে ও রুক্ষ হয়ে ওঠে ।গত পাঁচ বছর ধরে আদরের পরিবর্তে অনেক অনাদর আর অত্যাচার
সহ্য করতে হচ্ছে চন্দ্রাকে।নিজের পোশাকের নীচে অনেক আঘাতের চিহ্ন নিয়ে বাইরে হাসিমুখ
দেখিয়ে রোজগারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে ওকে। চন্দ্রা ভাবে এই সহ্যশক্তি ও নারী হয়ে না
জন্মালে কখনোই পেতো না। আর তার একটা নারীমন
না থাকলে কি সুজয়কে এখনো একভাবে ভালোবেসে যেতে পারতো না সুজয়ের নিজস্ব ইলেকট্রিক্যাল গুডসের
দোকানের স্বপ্নকে এখনো নিজের মনের মধ্যে জিইয়ে রেখে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত টাকা রোজগারের চিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত
রাখতে পারতো ! ও নারী জন্ম পেয়েই সেটা করতে
পারছে বলে ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকে ।ওর নারী দেহ আছে বলেই অনায়াসে
বিশেষ বিশেষ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকের সহানুভূতি কেড়ে নিয়ে সুজয় আর ওর জয়েন্ট সেভিংস একাউন্টটা
এরই মধ্যে যথেষ্ট ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিতে পেরেছে
। তবে এই দুনিয়াতে টাকা রোজগারের ব্যাপারটাই যখন গিভ এন্ড টেকের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত
,তখন চন্দ্রাকেও মাঝে মধ্যে একটু আধটু দিতে হয় বৈ কি ।তবে ওর বেলায় দেওয়া কম নেওয়াটাই বেশি ।খুব বয়স্ক লোকের ভালোবাসার মধ্যে
অপত্য স্নেহের ভাগটা একটু বেশি পরিমাণে থাকায় খুব
একটা বাড়াবাড়ি কেউই করে না ।সব সময়েই একটা লিমিটের মধ্যে থাকে।তাই ওর মনে বিন্দুমাত্র
অনুতাপ নেই । ওর লক্ষ্যে ও স্থির ।আর মাস দুয়েকের মধ্যেই সুজয়কে তার নিজস্ব দোকানে মালিক করে বসাতে পারবে বলেই ওর
বিশ্বাস ।কিন্তু মুশকিলে পড়েছে শর্মাজীকে নিয়ে ।জন্মসূত্রে পাঞ্জাবী কিন্তু কয়েক পুরুষ
ধরে বাংলায় থেকে তিনি এখন বাঙালিই বেশি, পাঞ্জাবী কম।ওঁর সঙ্গিসাথীও বেশিরভাগ বাঙালি।বছরের প্রায় সাত আট মাস তাঁর দিল্লিতে কাটে তাই দিল্লিতেও বাড়ি আছে। বয়স হলেও চেহারায় এখনো যথেষ্ট জৌলুশ আছে। উনি আবার অল্পেতে খুশি নন, একটু বেশিই চান
। এদিকে সাহায্যের সময়,দেবার হাত দরাজ । চন্দ্রা চাইছে কৌশলে এই দুটো মাস যদি পাঁকাল
মাছ হয়ে শর্মাজীর হাত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে , তাহলেই কেল্লা ফতে । বেশিরভাগ
সময়টাই তখন ও সুজয়ের দোকানে ওকে সাহায্য করে কাটাবে আর ধীরে ধীরে ওর সোসাইটি গার্লের
ইমেজটাও মুছে ফেলবে । কিন্তু আজ একাত্তর নম্বর বাড়িতে এসেই জেনেছে শর্মাজী আসবেন না।
ওনার কাছ থেকে কিছু টাকা পাওয়া গেলে খুব সুবিধা হোতো ।হয়তো বিশেষ কোনও কারণে আসেন নি । কি আর করা যায় ? নিয়ম
মতো ঘণ্টা দেড়েক বাকি সকলের সঙ্গে কাটিয়ে চন্দ্রা অটো নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবে ভাগ্যিস ওর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে কারোর বিশেষ মাথাব্যথা নেই ! এছাড়া সুজয়ও জানে ও
দু তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ করতেই রোজ সকালে
বিকেলে বেরোয় । বেরোতে
হয় ওকে না হলে খাওয়া জুটবে না । কিন্তু এই এক্সট্রা দেড় দু ঘণ্টা যে মাঝে মধ্যে ও মেয়ে হয়ে জন্মানোর ফায়দা ওঠাচ্ছে
, বয়স্ক পুরুষদের মনে সুড়সুড়ি দিয়ে কিছু এক্সট্রা ইনকাম করে তার একান্ত
ভালবাসার লোকের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন করে নিয়ে তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টা
করছে , সেই ব্যাপারটা সুজয় জানে না।ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলেই এখনো কিছু জানায় নি। কিন্তু
এই শর্মাজী ওরফে মনসুখ শর্মার মাত্রাতিরিক্ত সাহায্য করার ইচ্ছেটা ওকে ইদানীং ভাবায়
।ওর ভাগ্য ভালো সুজয় এসব জানে না অন্তত: সুজয় ওকে এখনো এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করে নি । এইসব নানান রকম ভাবতে ভাবতে
কখন নিজের স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে চন্দ্রা খেয়াল করেনি।ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরে
পেয়ে নেমে পড়ে ভাড়া মিটিয়ে হন হন করে বাড়ির দিকে
হাঁটা দেয় । বাড়ির লোহার গেট খুলে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে চন্দ্রা । বুকের রক্তে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে । মুখে ঢোঁক গেলার
মতো পর্যাপ্ত লালার যোগান নেই ।বিস্ফারিত চোখে শুধু দেখতে পায় শর্মাজী ওদের বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে ।পিছনে ক্র্যাচে ভর
দিয়ে সঙ্গে সুজয় । চন্দ্রা দুপা পিছিয়ে গিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায় ।কি মনে করে আগেই
মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়েছিলো । তবু যাবার সময় শর্মাজী ওর মুখের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে গলির মুখে পার্ক করে রাখা নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে
গেলো । চন্দ্রা বুঝতে পারলো না পাশের বাড়ির উঠোনে জ্বলতে থাকা চল্লিশ ওয়াটের বাল্বের
আলোয় শর্মাজী ওকে চিনতে পেরেছে কি না। ঘরে ঢুকে সুজয়কে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ও বলল
“মিঃ মনসুখ শর্মা এসেছিলেন ওই ইলেকট্রিকের দোকান থেকে ঠিকানা যোগাড় করে । বছর কয়েক আগে আমি ওনার বাড়িতে নাকি কিছু কাজ করেছিলাম । তার টাকাটা সুদে আসলে দিয়ে গেলেন ।আমার অবশ্য মনে
নেই কি কাজ করেছিলাম”, বলে টেবিলের
উপর রাখা একগুচ্ছের বড় বড় নোটের দিকে আঙুল তুলে দেখল । চন্দ্রা জিজ্ঞাসা করে ‘ তুমি ওনাকে চিনতে ?” সুজয় বলে “ হ্যাঁ , দোকানে
যখন কাজ করতাম , আসতেন মাঝে মাঝে । তাও সে অনেকদিন আগে , আমাদের বিয়ের আগের কথা । বেশ
পয়সাওয়ালা,রঙিন মেজাজের লোক। তবে এমন লোক হঠাৎ
আমার মতো লোকের বাড়িতে কেন যেচে এসে টাকা দিয়ে
গেলেন সেটাই ঠিক বুঝতে পারছি না । বললেন কোনও এক সময়ে আমার কথা আর বাকি থেকে
যাওয়া টাকাটার কথা মনে পড়ায় মানসিকভাবে কুন্ঠা বোধ করছিলেন ।বললেন বয়স হয়েছে,কখন কি
হয়, তাই যাবার আগে এ জন্মের ঋণ রেখে যেতে চান না । যা বকেয়া ছিল তার থেকে বেশি দিয়ে
গেলেন ।বললেন এতদিনের ইন্টারেস্টও তো ডিউ হয়েছে । পয়সাওয়ালা মেজাজি লোক কি মনে হয়েছে
কে জানে! আবার আসবেন বলেছেন ।এলে তুমি কিন্তু
সামনে থেকো না’। চন্দ্রা টেবিলের উপর পড়ে থাকা টাকাগুলোর দিকে আর একবার দেখে ভ্রু কুঁচকে
বলল,‘পাগল হয়েছ ,আমি থাকতে যাবো কেন?’ বলে চন্দ্রা পড়ুয়া ছেলের পাশে বসে তার পিঠে মাথায়
হাত বোলায় আর মনে মনে বলে ‘তাহলে যে তোমার
দোকান নিয়ে আমার এতদিনের স্বপ্ন দেখাটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে সুজয় !’